36 C
Dhaka
Saturday, April 27, 2024

বাংলাদেশের প্রথম গণ-আদালত যেভাবে গঠিত হয়েছিল

চাকুরির খবর

অনলাইন ডেস্ক: ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর খবরের কাগজে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয় যে, গোলাম আজমকে জামায়াতে ইসলামী তাদের আমির ঘোষণা করেছে। এই ঘোষণা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষের মধ্যে জনবিক্ষোভের তৈরি করে। পার্লামেন্টেও এর তীব্র প্রতিবাদ জানায় তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ।

পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর গোলাম আজমের পাসপোর্ট বাতিল করেছিল বাংলাদেশের সরকার। ১৯৭৮ সালে তিনি পাকিস্তানি পাসপোর্ট এবং বাংলাদেশের স্বল্পমেয়াদি ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে আসেন।

আওয়ামী লীগের নেতারা তখন সংসদে বলেন, পাকিস্তানি পাসপোর্টধারী একজন ব্যক্তি, যুদ্ধাপরাধী দেশের একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান হতে পারেন না।

শাহরিয়ার কবির বলছেন, ‘তখন আমরা চিন্তা করলাম, বিচ্ছিন্নভাবে না করে বড় ধরণের একটা প্রতিবাদ হওয়া দরকার। জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে কর্নেল নুরুজ্জামানের বাসায় কয়েক দফা বৈঠক হলো। তখন ভাবা হলো, বড় একটা প্লাটফর্ম দরকার।”

তিনি বলেন, ‘প্রথম দফায় ১০১ বিশিষ্ট নাগরিক মিলে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করা হলো। সেখান থেকে সরকারকে হুঁশিয়ারি দেয়া হলো যে, গোলাম আযম একজন যুদ্ধাপরাধী। সে বিদেশি নাগরিক হয়েও সংবিধান লঙ্ঘন করে একটি দলের প্রধান হয়েছে। সরকারকে আল্টিমেটাম দেয়া হলো যে, ২৫শে মার্চের মধ্যে তার বিচার করতে হবে। না হলে ২৬শে মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণ আদালত করে আমরা গোলাম আযমের বিচার করব।’

১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি জাহানারা ইমামকে আহবায়ক করে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করা হলো। ১৯৯৪ সালে জাহানার ইমামের মৃত্যুর পর এই কমিটির সভাপতি হন শাহরিয়ার কবির।

শাহরিয়ার কবির বলছিলেন, যখন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলো, তখন তারা জানালো, এখানে একটা সমন্বয় কমিটি গঠন করা উচিত। কারণ একা নির্মূল কমিটির পক্ষে এতো বড় প্রোগ্রাম করা সম্ভব হবে না। একটা মোর্চা দরকার।

তখন ১৩টি রাজনৈতিক দল ও ৫৯টি সংগঠন- মোট ৭২টি সংগঠন মিলে ফেব্রুয়ারির ১১ তারিখে গঠন করা হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি। সংক্ষেপে বলা হতো সমন্বয় কমিটি। সেটারও আহবায়ক ছিলেন জাহানারা ইমাম। ৭২টি দলের সদস্যদের নিয়ে একটি স্টিয়ারিং কমিটি ছিল।

শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘আমরা সমন্বয় কমিটি থেকে ঘোষণা দিলাম যে, ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণ-আদালতে গোলাম আযমের বিচার হবে। ১৯৬৭ সালে ভিয়েতনামে আমেরিকান যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য জাঁ পল সাত্রে এবং বার্টান্ড রাসেল একটা পিপলস ট্রাইব্যুনাল করেছিলেন। সেটা থেকে আমরা গণ-আদালতের ধারণাটি নিয়েছিলাম। সরকার যদি না করে, এটা হচ্ছে যুদ্ধাপরাধের একটা প্রতীকী বিচার। তবে আমরা ভেবেছিলাম, ঘরের ভেতরে নয়, লাখ লাখ মানুষের সামনে বিচারটি হবে।’

একটা আদালতে যা যা করা হয়, তার সবকিছুর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বিচারকদের একটি প্যানেল, ভুক্তভোগী অভিযোগকারী, সাক্ষী, প্রসিকিউশন। গোলাম আযমের পক্ষে কাকে সমন করা হবে, সে না এলে তার পক্ষে আইনজীবী দেয়া হবে, ইত্যাদি প্রস্তুতি নেয়া হয়। ‘রাজনৈতিক দলগুলো আমাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করলো। মার্চের এক তারিখ থেকে সবগুলো পত্রিকায় কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেল।’

কিন্তু তখনকার বিএনপি সরকার এ ধরনের কোন জমায়েতের পক্ষে ছিল না। ওই সময় ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা থেকে ওই বিচারের আয়োজন প্রত্যক্ষ করেছিলেন সাংবাদিক জুলফিকার আলী মানিক।

তিনি বলছেন, ‘তখন একটা টেনশন তৈরি হচ্ছিল। কারণ আন্দোলন দানা বেঁধে উঠছিল, আবার বিএনপি সরকার আন্দোলনটা চাচ্ছিল না। সরকার গণআদালত ঠেকানোর চেষ্টা করছিল। গণ-আদালতের দিনে ঢাকা শহর প্রায় ব্লক করা হয়েছিল। পুলিশ বিভিন্ন রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়েছিল, যাতে মানুষ গণআদালতের দিকে যেতে না পারে এবং আদালতটা না হতে পারে। কার্ফ্যু না দিলেও পরিস্থিতিটা ছিল সেইরকম। রাস্তায় কোন যানবাহন ছিল না। আমি নিজেও পূর্ব রাজাবাজার থেকে হেঁটে হেঁটে শাহবাগে গিয়েছিলাম।’

আলী মানিক বলেন, ‘বাংলামোটর, পরীবাগ, শাহবাগের মোড়ে, পুলিশের ব্যারিকেড ছিল, প্রচুর পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। গণ-আদালত শেষ পর্যন্ত হতে পারবে কি পারবে না, একটা টেনশন ছিল।’

শাহরিয়ার কবির বলছেন, ‘সরকারের নিষেধ সত্ত্বেও আমরা আমাদের সব প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। সেখানে কলরেডির ৫০০ মাইক বাঁধা হয়েছিল। ২৪ তারিখে সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে দিয়ে বলল, কোনরকম সমাবেশ করা যাবে না। আমাদের মঞ্চ-মাইক সব খুলে নিয়ে গেল। তখন আমরা বললাম, ঠিক আছে, সরকার যদি বাধা দেয়, যেখানে বাধা দেবে, সেখানেই আমরা রায় ঘোষণা করব।’ সকালে সবাই প্রথমে সুপ্রিম কোর্টের বারে সমবেত হন। সেখানে প্রথমে রায়ে স্বাক্ষর করা হয়।

‘কিন্তু আমরা যখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গেলাম, দেখি লক্ষ লক্ষ মানুষ সব বাধা ভেঙ্গে জড়ো হয়েছে। এর ক্রেডিট অবশ্য শেখ হাসিনার। তার সঙ্গে আমরা আগের দিন মিটিং করেছিলাম। তাকে বলেছিলাম, এটা তো আমাদের সফল করতে হবে। তখন তিনি আমাদের সামনেই আদমজীতে ফোন করলেন, আরও কয়েক জায়গায় ফোন করে বলছেন, সবাইকে আসতে হবে।’ প্রতীকী হিসেবে সেখানে গোলাম আযমের একটি কুশপুতত্লিকাও তৈরি করেছিল সমাবেশে অংশ নেয়া জনতা।

‘সমাবেশে জাহানারা ইমাম মুখে মুখে রায় ঘোষণা করলেন। সেখানে আসলে কাউকে ফাঁসি দেয়া হয়নি, রায়ে বলা হয়, গোলাম আযমকে আমরা দশটি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করেছি, সবগুলো অপরাধ মৃত্যুদণ্ডের যোগ্য। সরকারের উচিত হবে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এই লোককে মৃত্যুদণ্ড দেয়া। সেখানে সব অপরাধের বর্ণনা দেয়া হয়,’ বলছেন শাহরিয়ার কবির। সেদিনের সেই পরিস্থিতির প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন সাংবাদিক জুলফিকার আলী মানিক।

তিনি বলেন, ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কাছে গিয়ে দেখি, মানুষের বেজায় ভিড়। আমার মতো বিচ্ছিন্নভাবে মানুষ আসতে আসতে পুরো উদ্যান ভরে গেছে। ক্রমেই মানুষের ভিড় বাড়ছে। গণ-আদালত নিয়ে মানুষের ভেতর প্রচণ্ড একটা কৌতূহল ছিল। কারণ বাংলাদেশে এর আগে গণআদালত হয়নি। অনেকের ধারণা ছিল, এখানে হয়তো সত্যি সত্যি বিচার হবে। কিন্তু এটা ছিল একটা প্রতীকী বিচার।’

জুলফিকার আলী মানিক বলছেন, ‘এত মানুষের ভিড় ছিল যে, মঞ্চের কাছাকাছি যাওয়া কঠিন ছিল। মঞ্চ করতে দেয়া হয়নি, জাহানারা ইমাম ও অন্যরা একটা ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে ছিলেন। মাইকও সরিয়ে নেয়া হয়েছিল, তারা হ্যান্ডমাইক দিয়ে কথা বলছিলেন।’

‘প্রায় দুপুর হয়ে গিয়েছিল। পুরো সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ভরে গিয়েছিল, কিন্তু কেউ কিছু শুনতে পারছিলেন না। ট্রাকের কাছাকাছি গিয়ে আমি শুনলাম, নেতারা চিৎকার করে কিছু বলছেন। ঠোঁট নাড়া দেখছি, হালকা হালকা শব্দ ভেসে আসছে।’

‘এ রকম কতক্ষণ পরে হঠাৎ কেউ একজন কিছু একটা বলল। তখন ট্রাকের কাছ থেকে এমুখ ওমুখ হতে হতে ছড়িয়ে পড়ল, ফাঁসি, গোলাম আযমের ফাঁসির রায়। অর্থাৎ ট্রাকের কাছে যারা শুনেছিলেন, তাদের কাছ থেকে মানুষের মুখে মুখে পুরো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানজুড়ে বার্তাটি ছড়িয়ে পড়ল’ স্মৃতিচারণ করছিলেন জুলফিকার আলী মানিক।

সেই আন্দোলনে শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক- সবাই সম্পৃক্ত ছিল বলে তিনি জানান। কোন রাজনৈতিক দলের কর্মী নয়, সে রকম অসংখ্য মানুষ সেখানে অংশ নিয়েছিলেন। তবে আওয়ামী লীগ ও অন্য রাজনৈতিক দলের কর্মীরাও অংশ নিয়েছিলেন।

রায় ঘোষণার পরের দিনেই এই আদালতের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত ছিলেন, এরকম ২৪ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করা হয়। পরবর্তী সময় তারা হাইকোর্ট থেকে জামিন পান। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এই মামলাটি বাতিল হয়ে যায়। তার আগেই আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব জাহানারা ইমাম ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালে ক্যান্সারে মারা যান।

জুলফিকার আলী মানিক বলছেন, সেই সময় পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে কোন সংগঠিত আন্দোলন ছিল না। কিন্তু এই গণ আদালতের পর থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে মানুষের মধ্যে একটি সচেতনতা তৈরি হতে শুরু করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি একটি ইস্যু হিসেবে সামনে চলে আসে।

সেই সময় থেকে সারা দেশে আন্দোলনটা ছড়িয়ে পড়ে। জাহানারা ইমামকে দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে জেলায় জেলায় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হতে শুরু করে।

সাংবাদিক জুলফিকার আলী মানিক বলছেন, ‘আন্দোলনটা যেমন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল, সহযোগী দলগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক মতবিরোধের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল সেই আন্দোলনের ওপরেও। ফলে পরবর্তীতে একটু ভাটাও পড়েছিল। কিন্তু এটা বলা যায়, সেই যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেটার ফলশ্রুতিতেই শেষ পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হয়েছে।’

- Advertisement -

আরও সাম্প্রতিক খবর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -

সর্বশেষ খবর