28 C
Dhaka
Thursday, November 21, 2024

ভুয়া ভোটার ব্যবহার করা যায় না বলে ইভিএম-এ অনীহা বিএনপির!‌

চাকুরির খবর

বিডিনিউজ ডেস্ক: জাতীয় সংসদ নির্বাচন হোক বা স্থানীয় সরকার নির্বাচন, নির্বাচন দেশের মানুষের কাছে একটি উৎসব। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে শুরু হয় সাজসাজ রব। পোস্টারিং, প্রচারণা, প্রার্থীদের ভোটারদের বাড়ি বাড়ি ছোটাছুটি, নির্বাচনি আমেজকে এনে দেয় অন্য মাত্রা।

নির্বাচনের দিন এবং প্রার্থীদের জয়-পরাজয় নিয়ে শুরু হয় আরেক ক্লাইম্যাক্স। দিনভর ভোটগ্রহণের পর চলে গণনার কাজ। অনেক রাত পর্যন্ত গণণার পর ফলাফল ঘোষণা। আর ফলাফল আশানুরূপ হলে স্থুল বা সূক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ চেনা দৃশ্য ভোটারদের কাছে।

তবে ভোট গণনার ক্ষেত্রে ব্যালট বাছাই, কালক্ষেপণ, ভুল-ভ্রান্তির সুযোগ- এসব ফলাফলের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। এসব অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যা এড়াতে ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার শেখ হাসিনা সরকার ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন- ইভিএম প্রথা শুরু করে উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে।

দীর্ঘদিনের গবেষণা এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদদের সহায়তায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে তৈরি করা হয় ইভিএম ডিভাইসগুলো। যা ইন্টারনেটের সাথে সংযুক্ত থাকে না বলে বাইরে থেকে কারসাজি বা হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ নেই। ফলে এই ডিভাইসগুলোকে অত্যাধুনিক এবং নিরাপদ বলে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের কাছে প্রশংসিত হয়েছে।

শুধু তা-ই নয়, এই ডিভাইসগুলোর মাধ্যমে ভোটগ্রহণ সমাপনের পর কয়েক মিনিটের মধ্যে প্রতিটি কেন্দ্রের ফলাফল হাতে পাওয়া যায়। যা রাতভর দীর্ঘ প্রতিক্ষার অবসান ঘটিয়েছে। তাছাড়া কাগজের ব্যালট এবং সিল-কালির ঝক্কিমুক্ত ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়। ব্যালটবক্স কব্জা করতে কেন্দ্র দখল, সন্ত্রাসী কার্যক্রমসহ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও কমে আসে।

তবে সবচেয়ে বড় বিষয়টি হলো, ইভিএম প্রযুক্তির কারণে ভুয়া ভোটার এবং জাল ভোট প্রতিরোধ করা গেছে অত্যন্ত সহজে। আর এই বিষয়টি বিএনপি-জামায়াতসহ ক্ষমতার বাইরে থাকা অপর রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলাফল এবং নির্বাচন প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে অজুহাতের সুযোগ নেই এখন আর।

ইভিএম-এর মাধ্যমে ভোটগ্রহণ দেশের সর্বত্র যতই ছড়িয়ে পড়ছে, ততই দেশবিরোধী শক্তির ক্ষমতায় আরোহনের পেছনের দরজাগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এজন্য ইভিএম-এর সমালোচনায় মুখর বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো।

গত ১৬ই জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করার পর বিএনপিপন্থী নির্বাচন কমিশনার হিসেবে খ্যাত মাহবুব তালুকদার স্বয়ং স্বীকার করতে বাধ্য হলেন এটাই ‘সর্বোত্তম’ নির্বাচন। তিনি দিনভর অনেক কেন্দ্র ঘুরে ঘুরে দেখার পর এই মন্তব্য করেন।

ধু তিনি নন, পরাজিত প্রার্থী বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার পর্যন্ত সারাদিন বিভিন্ন টিভি চ্যানেল এবং পত্রিকাকে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় নির্বাচন ‘সুষ্ঠু’ হচ্ছে বলে জানান। যদিও পরাজয়ের পর যথারীতি ইভিএম-এর দোষ দিলেন। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারাও ইভিএম-এর নানারকম কাল্পনিক ত্রুটি নিয়ে বক্তব্য দেন। যদিও তা পাত্তা পায়নি।

ইভিএম যুগের পূর্বে নির্বাচনে কারচুপি করতে বিএনপি-জামায়াত দেশে ১ কোটি ৩৯ লাখ ভুয়া ভোটার তৈরী করেছিল:

২০০৬ সালের ১৭ই মে তারিখে চ্যানেল আই’র একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে আসে প্রায় দেড় কোটি ভুয়া ভোটার তালিকা প্রণয়নের ঘটনাটি। তাতে বলা হয়, খোদ নির্বাচন কমিশন কার্যালয় থেকেই ভুয়া ভোটার তালিকা তৈরীর নির্দেশ দেয়া হয় রেজিষ্ট্রেশন কর্মকর্তাদের।

আগারগাঁওয়ের ৪১নং ওয়ার্ডের সহকারী রেজিষ্ট্রেশন কর্মকর্তা আমিনুল হক ভুঁইয়া জানান, ১৩ই মার্চ, ২০০৬ তারিখে নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তা ৯০০ ভুয়া ভোটারের একটি তালিকা তাকে দেন। বিদ্যমান ভোটার তালিকার সাথে এই ৯০০ অতিরিক্ত ভুয়া নাম অন্তর্ভূক্ত করতে নির্দেশ দেয়া হয়। যে চিঠিতে স্বাক্ষর করেন থানা নির্বাচন কর্মকর্তা আফরোজা খানম।

কিন্তু এই ৯০০ ভুয়া নাম অন্তর্ভূক্তিতে অস্বীকৃতি জানান রেজিষ্ট্রেশন কর্মকর্তা আমিনুল। চ্যানেল আইকে তিনি জানান, এই ৯০০ জনের নাম ‘তাদের’ নিজস্ব লোকজন দিয়ে করিয়েছে, যাদের অস্তিত্ব নেই, তাই এসব নাম অন্তর্ভূক্ত করতে রাজি নন বলে সাফ জানিয়ে দেন আমিনুল।

এরপর নির্বাচন কমিশন থেকে তাকে নির্দেশ দিয়ে বলে- মোহাম্মদপুর থানাধীন ৪১নং ওয়ার্ডের পশ্চিম আগারগাঁও এলাকার বাদ পড়া ভোটারদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে মোহাম্মদপুরের শ্যামলী প্রি-ক্যাডেট একাডেমি হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষক মো. আতিকুল ইসলামকে দিয়ে এই ভোটার তালিকা তৈরী করেন থানা নির্বাচন কর্মকর্তা।

আমিনুল জানান, এই তালিকা তৈরিতে শিক্ষক নিয়োগদানের কোনো তথ্যই নাই। তিনি অবাক হন, শুধুমাত্র মোহাম্মদপুর এলাকাতেই ৯০০ ভুয়া ভোটার! এভাবে সারাদেশে না জানি কয় কোটি ভুয়া নাম তালিকায় যুক্ত হচ্ছে!

আমিনুল হক এই কাজে অস্বীকৃতি জানালে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা সামসুল আলম তাকে আরেকটি নির্দেশ দিয়ে চিঠি পাঠান ১ এপ্রিল, ২০০৬ তারিখে। যেখানে বলা হয়, এই ৯০০ ভোটারের ঠিকানা মোহাম্মদপুর ও শ্যামলী এলাকায়।

৯০০ জনের তালিকার একটি কপি নিয়ে ঠিকানাগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, এসব ব্যক্তির কোনো অস্তিত্বই নেই। স্থানীয়দের কেউই এমন নামের কাউকে চেনেন না, এমনকি কখনও সেখানে এমন কেউ ছিল না বলে জানান।

এরপর ভুয়া নাম অন্তর্ভূক্তির চিঠির বিষয়ে মোহাম্মদপুর থানা নির্বাচন কার্যালয়ে গেলে নির্বাচন কর্মকর্তা আফরোজা খানম বিষয়টি এড়িয়ে যান। ক্যামেরার সামনে কথা বলতে রাজি হননি। জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাও কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

আফরোজা খানম জানান, তিনি এ বিষয়ে কোনো কথা বলবেন না। চাকরিটা হারাতে চান না। টিভি ক্যামেরা অন করতে বারণ করেন তিনি। এসব কথা জানাজানি হলে চাকরি চলে যাবে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।

এরপর জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা সামসুল আলমের কার্যালয়ে গেলে তিনিও কথা বলতে রাজি হননি, এমনকি প্রতিবেদক ও ক্যামেরাপার্সনকে বের করে দেন সেখান থেকে।

উল্লেখ্য, ২০০১ সালের ভোটার তালিকা অনুযায়ী, দেশে ভোটার সংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৪৮ লাখ। আর ২০০৬ সালে খসড়া তালিকায় দেখানো হয়েছে ৯ কোটি ১৩ লাখের বেশি ভোটার। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেব অনুযায়ী, ৫ বছরে ভোটার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ১.৪৮%। অথচ ভুয়া তালিকার তৈরীর পর ভোটার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৪.৪%।

এরপরেও ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি আওয়ামী লীগ এর নেতা-কর্মী এবং সমর্থকদের বড় একটি অংশের।

অনুসন্ধানী দল খোঁজ নেয় তথ্য সংগ্রহকারী শ্যামলী প্রি-ক্যাডেট একাডেমি হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষক মো. আতিকুল ইসলাম এর ব্যাপারে। পশ্চিম আগারগাঁও এলাকার ৯০০ ভুয়া ভোটারের রেজিষ্ট্রেশন ফরম পূরণ করেন তিনি। সেই শিক্ষকের বিষয়ে বিদ্যালয়ে গেলে জানা যায় বিস্ময়কর তথ্য।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মমিনুল্লাহ ভুঁইয়া জানান, শিক্ষক আতিকুল ইসলাম ৭ বছর পূর্বে (১৯৯৯ পর্যন্ত) এই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। বর্তমানে তার সম্পর্কে কিছুই জানেন না মমিনুল্লাহ ভুঁইয়া। এমনকি আতিকুল ইসলাম তথ্য সংগ্রহকারী হিসেবে যে সিল ব্যবহার করেছেন, তা এই স্কুলে ব্যবহৃত হয় না।

৪১নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বিএনপি নেতা আবু বকর ছিদ্দীকের প্রত্যক্ষ সহায়তায় এই ৯০০ ভুয়া ভোটারের তালিকাটি তৈরী করা হয় বলে জানায় চ্যানেল আই। ক্যামেরার সামনে তিনি দাবি করেন, এরা জেনুইন না হলে তাদেরকে বাদ দেয়া হোক, তার কোনো আপত্তি নাই।

প্রতিবেদক কাউন্সিলরের বাড়ি থেকে বেরোতেই দেখা যায়, বাড়ির সামনে বহু লোকের ভিড়। তারা জানান, ভোটার তালিকায় তাদের নাম ওঠেনি। কারণ জানতে চাইলে তারা জানান, তথ্য সংগ্রহকারীরা তাদের বাড়িতে যায়নি। বিষয়টি তারা কাউন্সিলর আবু বকরকে জানালে তিনি বলেছেন তোমরা তো আমারে ভোট দাওনাই, এখন কেন আসছ?

ভুয়া ভোটার তালিকা প্রণয়ন, থানা ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার কার্যালয়ে গেলে কেউই এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

বাড্ডা এলাকার প্রাক্তন পুলিশ কর্মকর্তা বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ মো. শাহজাহান এর বাড়ি- শ-৪৫/ক, উত্তর বাড্ডা ঠিকানায় যান প্রতিবেদক। বাড়ির মালিক হয়েও এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ভোটার হতে পারেননি। তার ভাড়াটেদেরও ভোটার করা হয়নি বলে জানান।

অথচ তার বাড়ির ঠিকানায় ১১ জন ভুয়া ভোটার তৈরী করা হয়েছে বলে তালিকায় দেখা যায়। যারা কখনই ওই বাড়িতে ভাড়াটে হিসেবে ছিলেন না বলে জানান বাড়ির মালিক মো. শাহজাহান। তার ১৬টি ফ্ল্যাটে ভোটার সংখ্যা ৫০ জনের মত, যাদের ২ জন বাদে কাউকেই ভোটার করা হয়নি।

বিষয়টি মো. শাহজাহান স্থানীয় কাউন্সিলরকে জানালে তিনি গ্রাহ্য করেননি। উল্টো জানান, যারা তালিকা করেছে, তারা কীভাবে করেছে, সেটা তাদের ব্যাপার। এ বিষয়ে তিনি (কাউন্সিলর) কিছু জানে না।

পার্শ্ববর্তী বাড়ির মালিক রফিকুল ইসলাম জানান, তার পরিবারের কাউকেই ভোটার করা হয়নি। কিন্তু তালিকায় ওই বাড়ির ভাড়াটে নয়, এমন কিছু ভূতুড়ে নাম যোগ করা হয়েছে। বয়ঃবৃদ্ধ সদস্যদের নামও ভোটার তালিকায় ওঠেনি।

কারণ জানতে চাইলে ওই বাড়ির ভাড়াটেরা জানান, এই বাড়িতে ভোটার তালিকা করার কোনো লোক আসেনি। তথ্য সংগ্রহকারীদের সাথে যোগাযোগ করলেও কোনো লাভ হয়নি বলে জানান তারা।

এসব বিষয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই ইভিএম-এর গুরুত্ব বোঝা যায়। একইসাথে এটাও বোঝা যায়, নির্বাচনে কারচুপির সুযোগগুলো বন্ধ হয়ে গেছে ইভিএম-এর কারণে। ভুয়া ভোটার সাজিয়ে নির্বাচনে কারসাজি করা যাচ্ছে না- এই বিষয়টি বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন গোষ্ঠী মেনে নিতে পারছে না।

সে কারণেই নির্বাচনে হারলে ‘যত দোষ, ইভিএম ঘোষ’ এর।

ঢাকা টেলিভিশন

- Advertisement -

আরও সাম্প্রতিক খবর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -

সর্বশেষ খবর