...
Monday, November 11, 2024

ছোট গল্প : ভয়

চাকুরির খবর

গল্প নয় সত্যি…
আমি যখন ক্লাশ সিক্সে পড়ি তখন থেকেই লজিং থেকে পড়া শুরু করি, কারণ আমাদের গ্রাম বা আশাপাশের কোন গ্রামে হাইস্কুল ছিল না। তখন থেকে আমি একলা ঘুমাতে আরম্ভ করি। এর আগে আমি আমার ভাইয়ের কাছে কখনো বোনের কাছে বা মায়ের কাছে ঘুমাতাম। সিক্সে থাকা অবস্থায় দু একদিন ভয়ে রাতে ঘুমাতেই পারতাম না। ফলে মাঝে মাঝে বাড়ি চলে আসতাম। তখন বাড়ি থেকে চয় সাত কিলো পথ হেটে গিয়ে ওই দশ এগার বছর বয়সে ক্লাশ করতে হত। ক্লাশ সেভনে উঠে এক বাড়িতে আমার লজিংয়ে থাকার ব্যাবস্থা হল। তাদের বাড়ির বারান্দায় আমি ঘুমাতাম। আমার রুমের পাশ দিয়ে ছিল চলাচলের রাস্তা।

একদিন বিকালে স্কুল থেকে এসে শুনি গ্রামে বাঘ এসেছে। আরো শুনা গেল যে সেই বাঘে নাকি ইতিমধ্যে দুইজন মানুষও মেরে খেয়েছে। সারা গ্রামের মানুষের মনে সেকি ভয়। সন্ধ্যার আগেই মানুষ জন সব ঘরে ঢুকে শক্ত করে খিল লাগিয়ে দিয়েছে। আমিও সেদিন পড়ায় মন বসাতে পারলাম না। সারাক্ষণ শুধু বাঘের চিন্তা মনে উকি দিতে লাগল। আমি আমার ঘরে একা। সবাই যার যার ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছে। রাত তখন সম্ভবতঃ এগারটা। গ্রামের বাড়িতে এগারোটা মানে গভীর রাত। আমি শুয়ে আছি। হঠাৎ শুনি আমার রুমের সামনের রাস্তায় খট খট শব্দ। আমি ভয়ে চুপ করে কাথা খানা ভালভাবে মুড়ি দিয়ে মড়ার মত পড়ে রইলাম।
রাত যত গভীর হচ্ছে ততই শব্দ ঘন হচ্ছে। একবার রাস্তার এপাশ থেকে অপাশ একবার ওপাশ থেকে এপাশ বাঘ দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছে। ওদিকে যারা ঘরে থাকেন তারা সেদিন বেড়াতে গেছে। আমি কি করি! ইচ্ছে হয় চিৎকার করে লোক জড়ো করি। আবার লজ্জায় পারি না। মাঝে মাঝে মনে হয় বাঘ বুঝি দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে তখন আমার বেহুশ হবার অবস্থা। এমনি করে সারারাত না ঘুমিয়ে ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে বিছানায় পড়ে থাকলাম মড়ার মত।
বেশ বেলা হলে ভয়ে ভয়ে দরজা খুলে দেখি কেউ কোথাও নাই। রাস্তায় নেমে দেখি ছোট বাছুরের অসংখ্য পায়ের দাগ শিশির ভেজা পথে পড়ে আছে। পরে খোজ নিয়ে জানতে পারলাম কার একটি বাছুর রাতে গোয়াল থেকে পালিয়ে এসে এই পথে দৌড়াদৌড়ি করেছে। আর আমি বাঘ ভেবে মরার উপক্রম হয়েছি।

২) ১৯৭১ সাল। এস এস সি পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছে। ৩মার্চ কোচিং ক্লাশ থেকে বেরিয়ে শফি ভাইয়ের নেতৃত্বে আন্দোলে ঝাপিয়ে পড়লাম
সারাদিন মিছিল করে এলাকা কাপিয়ে তুলতাম। গভীর রাতে বাড়ি ফিরি। আন্দোলনের গরমে কাউকে পাত্তা দেই না। শুধু আব্বাকে ভয় পাই। আমার উম্মি বাবার শিক্ষার প্রতি ছিল অদম্য উৎসাহ। লেখাপড়ায় ফাকি একদম পছন্দ করতেন না। আন্দোলনের ফাকে ফাকে তখন তাস খেলা শিখে ফেলেছি এক দুলা ভাইয়ের নিকট থেকে। মাঠের মিছিল একসময় স্তিমিত হয়ে গেল। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর দেশে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। গ্রামে সে ঢেউ তখনও আছড়ে পড়ে নাই।আমি পড়ায় মন দিয়েছি এরকম ভাব দেখালাম আব্বাকে। আসলে ভিভরে ভিতরে মারাত্মক অস্থির। এই অস্থিরতার মধ্যে পাশের বাড়ি তাস খেলতে যাই রাতের বেলা। একদিন আমার বোন একথা খুব রসিয়ে রসিয়ে আব্বার কানে দিল। আব্বা তাকে হুকুম দিয়েছেন আমাকে ধরে তাকে খবর দিতে। সে আর আমি ছিলাম পিঠাপিঠি, তাইতে নাকি চির শত্রুতা। একদিন যেইনা আমি তাস খেলে বাড়ি এ
ফিরেছি সে আমাকে ঝাপ্টে ধরে আব্বাকে ডাক দিল, তাড়াতাড়ি আস চোর ধরেছি, আজ আর নিস্তার নাই। আমি শুনি আব্বার খড়মের শব্দ। তার মারার অস্ত্র ছিল খড়ম। খড়মের যে কি মার! যে খেয়েছে সারাজীবন মনে থাকবে তার। আমি কোন রকম নিজেকে ছাড়িয়ে আমার বোনের কপালে একটি কড়ি( বড় মার্বেল) জোরে মেরে পালালাম। পালানোর সময় হাতে নিয়ে নিলাম ওই সময়ের আমার সার্বক্ষণিক সাথী একখানা মুজিব লাঠি এবং একখানা সেভেন গিয়ার চাকু।
রাত তখন বারটা বাজে আমার বড় বোনের বাড়ি রওয়ানা হলাম। তাদের বাড়ি যেতে হলে আমাদের বিখ্যাত শৈলকোপার বিল পাড়ি দিতে হবে। এই বিলের ছিল ভুতের ভয়ের দুখ্যাতি। কত লোকে যে এ বিলে ভুত দেখেছে তার ইয়ত্তা নাই। এই বিলে কেউ তখন দিনেও একা যেত না। শুনেছি এ বিলে ভুতে মানুষের ঘড় মটকিয়েছে বহুবার। এ বিলে মাত্র কয়েকদিন আগে একজন খুন হয়েছে। রাতের বেলায় ভুত দৌড়াদৌড়ি করতে দেখেছে অনেক লোকে। এই বিলের দুইপ্রান্তে দুটি বটগাছ ছিল। ভুত নাকি রাতের বেলায় এই দু গাছে দু পা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আর গভীর রাতে কেউ এর নীচে গেলে চেপে মেরে ফেলে।

মুজিব লাটি আর সেভেন গিয়ার বাগিয়ে আমি নেমে পড়লাম এই বিলে। গা ছম ছম করছে সত্য কিন্তু আব্বার খড়মের কথা মনে পড়তেই সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
বিলের মাঝামাঝি গেলেই ভুতের দেখা পেলাম। দেখি পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে ভুত হেটে যাচ্ছে। শুনেছি ভুত চলার সময় নাকি তার মুখ দিয়ে আগুন বেরোয়। সে আগুন একবার নিভে একবার জ্বলে। এও ঠিক তাই। একবর আগুন জ্বলছে একবার নিভছে। আমি একবার ভাবি পিছনে ফিরে দৌড় দেই, শ আবার, শুনেছি ভুতের হাত থেকে দৌড়ে পালানো যায় না। ভুত এসে ঘাড়ে এসে পড়ে। আমি জানতাম ভুত কখনো চাষ দেয়া জমির ভিতর নামে না লাঙ্গলের ফালের ভয়ে। তাই আমি চাষ দেয়া জমির ভিতর দিয়ে দুরুবুকে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছি। ভুত আর আমি ৯০ ডিগ্রি কোণাকুণি এগিয়ে চলেছি। ভুতও এগিয়ে চলে আমিও এগিয়ে চলি। বুকে অসম সাহস নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। হারা যাবে না। এই আমার প্রতিজ্ঞা। ভুতের কাছাকাছি এসেই আমার দম বন্ধ যাবার অবস্থা হল। ঠিক সেই মুহূর্তে দেখলাম আরে এ ভুত কোথায়! তিন জন লোক এবং একটা ঘোড়া দেখতে পেলাম। ঘোড়ার পিঠে বস্তা। একজন লোকের হাতে হেরিক্যান। হেরিক্যান হাতে লোকটা হাটে আর লুঙ্গির ছায়ায় আলো আড়াল হয় আবার পা বাড়ালে আলো দেখা যায় তাতেই মনে হয় আলো নিভে আর জ্বলে। আমি তাদের দেখে হাফ ছেড়ে বাচলাম। এই হল আমার ভুত দেখা। আমি দ্রুত বোনের বাড়ির দিকে হাটতে থাকলাম। রাত একটার দিকে সেখানে পৌছিলাম। আমার বুজিতো আমাকে দেখে ভুত দেখার মত প্রথমে আঁতকে উঠল এর পরে শুরু করল নাকি কান্না। এর পর কাচি পুড়িয়ে পানির ভিতর দিয়ে সেই পানি পান করতে বাধ্য করল আমাকে।
এর কিছুদিন পর যুদ্ধে গেলাম। বিহারের চাকুলিয়ার পাহাড়ী গভীর অরন্যে আমাকে একা ছেড়ে দেয়া হল। সাপ কোপ ভুত বাঘ ভাল্লুক কত কিছুর মধ্যে। একটুও ভয় পাই নাই। দেশে এসে কত কবরস্থান শ্মশান অরন্য কতসব ভয়ংকর জায়গায় যে গিয়েছি, ক্রশ ফায়ারের ভিতর অবলীলায় এগিয়ে গিয়েছি শত্রু হননে। ভয় আমাকে আর কোন্দিন ভয় দিতে পারে নাই।
চিত্ত যেথা ভয় শুণ্য, মুক্ত সেথা মন।

লেখক
রুস্তম আলী মোল্লা
বীর মুক্তিযোদ্ধা

- Advertisement -

আরও সাম্প্রতিক খবর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -

সর্বশেষ খবর

Seraphinite AcceleratorOptimized by Seraphinite Accelerator
Turns on site high speed to be attractive for people and search engines.