বইমেলার স্মৃতি
————-জয়ন্ত পন্ডিত
বেশ কয়েক বছর ধরে একুশের বই মেলায় যাওয়ার পূর্ব মূর্হুতে বিভিন্ন ধরণের সমস্যায় আর যাওয়া হয়ে উঠেনি। এ জন্য মনে সারাবছর একধরণের শূণ্যতা বিরাজ করতো। আর কবি কিংবা লেখকের সাথে সঙ্গী হয়ে বই মেলায় যাওয়া বেশ আনন্দময়। তাই, এরকম সঙ্গীদের সাথে টাইমিংটা ঠিকমতো হচ্ছিলো না। তবে গত বই মেলায় কয়েকজন লেখক নামমাত্র একজন পাঠককে তাদের সঙ্গী হওয়াটা শুভনীয় নয় ভেবে কথা দিয়েও তাদের সঙ্গে না নিয়েই বইমেলায় চলে গিয়ে আমাকে মর্মাহত করলো।
বইমেলায় যেতে পারলামনা ভেবে মনটা খারাপ, তাই দুপুরের খাবারটা কিছুটা অনীহা নিয়ে খেয়ে শুয়ে ছিলাম আমার রুমে। মনটা অনেক খারাপ, তাই ভাবলাম লমিলতার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলি যদিবা বুকের ভিতর জমে থাকাটা পাথরটা একটু হালকা হয়। যদিও আজকাল কলমিলতার সাথে নিয়মিত কথা হয়না দুজনের খানিক অভিমানের কারণে। তবু আজকে অভিমানের বরফ গলাতে আমি নিজেই দায়িত্ব নিয়ে মোবাইলে কল দিতে হয়ে হঠাৎ মনে পরে গেল, কিভাবে কিছুটা গোপনে তার এক বন্ধুর কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিলাম তার মোবাইল নাম্বারটা।
সেদিন ছিল বর্ষাকাল, তাই কলেজ মাঠে ফুটবল খেলার বেশ তোড়জোড় চলছিলো। এমন সময় হঠাৎ আমাকে কিছুটা অবাক করে দিয়ে কলমিলতার এক ঘনিষ্ট বন্ধু তার কলেজ ব্যাগটা আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বললো, তুই এটা রাখ আমি ফুটবলটা খেলে আসি। তবে সাবধান আমার মোবাইলটা কিন্তু রয়েছে এরমধ্যে। আমি যেন এসুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম বেশ কিছুদিন ধরেই। তাই মনে মনে বেশ শিহীরত হলাম। এদিকে কলেজ মাঠে বৃষ্টিতে ফুটবল খেলাটাও বেশ জমে উঠেছে। সকলেই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে মাঠের দিকে, এই সুযোগে আমার অনেক প্রতীক্ষারত কাজটা দ্রুত সেরে ফেলতে হবে। আমি বন্ধুর ব্যাগটা থেকে অতি সাবধানে তার মোবাইলটা বের করে নিলাম। যদিও বন্ধুর মোবাইলের লক খোলার প্রক্রিয়াটা আমার আগেই জানা ছিলো, তাই কাজটা খুব সহজ হয়ে গেলো। মোবাইলটা হাতে নিয়ে আমি এমন একটা ভাব নিলাম যেন নিজের মোবাইলটা নিয়েই আনমনে নাড়াচাড়া করছি। কিন্তু আসল কথা হলো কলমিলতার মোবাইল নাম্বারটা খুঁজছিলাম এবং ভাগ্য সুপ্রসন্ন হওয়ায় অল্প সময়েই তা পেয়ে গেলাম। কলমিলতার মোবাইল নাম্বার এক নিমিষেই মুখস্ত করে ফেললাম এবং বন্ধুর মোবাইলটা তার ব্যাগে সঠিক জায়গায় রেখে দিলাম।
আমার মনটা অস্থির হয়ে গেলো এটা ভেবে, যে কখন কলমিলতার mv‡_ কথা বলবো। একসময় বৃষ্টি কমলো এবং মাঠের খেলাও শেষ হলো কিন্তু আমার হৃদয়ের অন্তঃপুরে নতুন করে খেলা শুরু হয়ে গেলো। বাসায় ফিরে কিছুটা ভয়ে ভয়ে কলমিলতাকে মোবাইলে কল দিয়ে নিজের পরিচয় দিলাম এবং খেয়াল করলাম সেও বেশ আন্তরিকভাবে কথা বলছিলো আমার সাথে। কলমিলতা বিষয়টা সহজভাবে নেওয়ায় আমার মনের সাহসটা যেন আরও দ্বিগুণ হয়ে গেলো। প্রথম দিনই
আমাদের দুজনের কথা চললো বেশ কিছুক্ষণ। এরপর নিয়মিত কথা হতো আমাদের। যাই হউক, কলমিলতার সাথে কথা বলে জানতে পারলাম সে নাকি বইমেলায় গেছে ঘুরতে এবং আমাকেও বললো বই মেলায় চলে যেতে। কথাটা শুনে আমিও বলে দিলাম আগামিকাল বইমেলায় দেখা হবে। রাতে দুচোখের পাতা এক করতে পারিনি মনের ভিতরের চাপা উত্তেজনায়। কাক ডাকা ভোরে বাসে করে চলে গেলাম বইমেলা এলাকায়। সেখানে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন কলমিলতা আসবে এবং তাকে সঙ্গে নিয়ে বইমেলায় যাব। আমার অপেক্ষার পালা কিছুক্ষণ পরেই শেষ হলো এবং কলমিলতা আমার সামনে এসে দাঁড়ালো।
নীল রংয়ের শাড়ি-ব্লাউজে এবং কপালে ছোট নীল টিপে যেন একদম নীল পরীর মতোই লাগছিলো কলমিলতাকে। আমার বুকের ভিতরের প্রতিটি রক্তবিন্দু যেন উত্তেজনায় টগবগ করে ফুঁটতে লাগলো। প্রাথমিক আলাপচারিতা শেষ করে আমরা বইমেলায় প্রবেশ করলাম এবং ভীড় সামলে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন প্রকাশনীর স্টলে বই দেখলাম। আমি বার বার আড়চোখে তারদিকে দেখছিলাম কিন্তু জোর করে চোখটা বার বার সরিয়ে নিতে হচ্ছিলো কেননা যদি আবার ধরাপড়ি যাই, তাহলে
লজ্জায় পরতে হবে।
সবশেষে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে জনপ্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদের কয়েকটি উপন্যাস কিনলাম এবং কলমি লতাকে উপহার দিলাম। প্রচণ্ডে গরমে কলমিলতার নাক-মুখ ঘাম ছিলো। আমার বার বার ইচ্ছা করছিলো কলমিলতার নাকের ঘামটা নিজ হাতে মুছে দিতে কিন্তু সাহস হচ্ছিলোনা। আমরা বইমেলায় অনেকক্ষণ ঘুরাঘুরি করে সেখান থেকে বেরিয়ে পাশে খোলা মাঠে বসে চটপটি খেলাম এবং কথার মালা তৈরী করছিলাম একে অপরকে মুগ্ধ করার জন্য।
কিছুক্ষণ পরে একটা ছোট ছেলে এসে বললো ভাই কয়েকটা ফুল নিয়ে আপার মাথার চুলে গুজে দেন অনেক সুন্দর লাগবো। আমারও মায়া হলো এবং কয়েক রকমের ফুল কিনে কলমিলতার হাতে দিলাম। আমাদের সময়টা দ্রুত ফুরিয়ে আসতে লাগলো এবং চারপাশে জ্বলে উঠা নিয়নের আলো, যেন আমাদের নিয়তির পথে চালিত হওয়ার বার্তা দিয়ে যাচ্ছিলো। আমাদের কথার পর্ব শেষ করে উঠতে হলো এবং বিদায় নিয়ে কলমিলতা রিক্সায় উঠলো। তখন সঞ্জীবন চৌধুরীর ” রিক্সা
কেন আস্তে চলেনা, রিক্সা যাচ্ছে হাওয়ায় উড়ে, আমার হৃদয় তুচ্ছ করে, রিক্সা কেন আস্তে চলেনা” এ গানটার কথা বার বার মনে হচ্ছিলো।
কলমিলতা চলে গেলো আর জীবনে চলার পথে কখনো আমাদের দেখা হবে কিনা বলতে পারবোনা! তবু জীবনে এরপর থেকে
যতবার বইমেলায় যাব ঠিক ততবার কলমিলতার কথা মনে করে বুকের ভিতরটা হু হু করে উঠবে।