তৃণমূল আওয়ামী লীগে দলাদলি, দ্বন্দ্ব-কোন্দল ও বিরোধের জন্য দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনই মূল কারণ হিসাবে দেখা যাচ্ছে।
টানা ১২ বছর দল ক্ষমতায় থাকায় নানা রকম বৈষয়িক ও স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছে এমনটা মনে করা হলেও, সেটার চেয়ে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনকেই মূল কারণ হিসাবে মনে করছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সফরে গিয়ে এই বিষয়টি ধরা পড়েছে তাদের চোখে।
পাশাপাশি তৃণমূলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতাদের চলমান বৈঠকেও দ্বন্দ্ব-কোন্দল ও বিরোধের মূলে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচনের বিষয়টি উঠে এসেছে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, মাঠ পর্যায়ে ব্যক্তিগত রেষারেষির ও দ্বন্দ্ব-কোন্দল সবসময় একই রকম ছিল।
কিন্তু সমস্যাটা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচন প্রক্রিয়ায় দলীয় প্রতীক বরাদ্দ দেওয়ার নিয়ম শুরু হওয়ার পর থেকেই। নির্বাচনের যে ধারা বর্তমানে চলমান, তাতে অনেকের মধ্যে এমন একটা প্রত্যয় জন্ম নিয়েছে যে, প্রতীক হিসাবে নৌকা পাওয়ার অর্থই হচ্ছে বিজয় অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যাওয়া।
আর এ কারণেই নির্বাচনের সময় এই বিরোধটা তীব্র ও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। মনোনয়ন প্রত্যাশী ও তাদের সমর্থিত কর্মীরা একে অপরের বিরুদ্ধে বিষোদগার লিপ্ত হয়।
মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে এই বিরোধের ধারা উপজেলা- জেলা পর্যন্ত চলে আসে। দলের মধ্যে তৈরি হয় বিভিন্ন গ্রুপ, উপদল।
২০১৫ সালে পৌরসভা নির্বাচন দলীয় মনোনয়নে হয়। এর মধ্য দিয়েই আসলে স্থানীয় সরকার পরিষদের নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে অনুষ্ঠানের বিধান শুরু হয়।
আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে পর্যায়ক্রমে এটি ইউনিয়ন পরিষদ, সিটি কর্পোরেশন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে পর্যন্ত প্রসারিত হয়। বর্তমান বিধান অনুযায়ী কেবল জেলা পরিষদ ছাড়া স্থানীয় সরকার পরিষদের সবগুলোই দলীয় ভিত্তিতে হচ্ছে।
দলীয় মনোনয়নে স্থানীয় সরকার নির্বাচন, ফলশ্রুতিতে দ্বন্দ্ব-কোন্দল বাড়তে থাকার বিষয়টি এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নজরেও এসেছে।
দলের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সভা সহ বিভিন্ন ফোরামে বিষয়টি আলোচনা হয়েছে। দ্বন্দ্ব কোন্দলের কারণে কোনও কোনও স্থানে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ কাউকে মনোনয়ন না দিয়ে সেটা উন্মুক্তও রেখেছেন।
এরই ধারাবাহিকতায় সদ্য অনুষ্ঠিত প্রথম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন চেয়ারম্যান পদে দলীয় মনোনয়ন না দিয়ে উন্মুক্ত রাখার চিন্তা হয়েছিল। অবশ্য শেষ পর্যন্ত সেটা আর করা যায়নি।
নির্বাচন দলীয় মনোনয়নের ভিত্তিতেই হয়েছে। তারপরও ২০৪টি ইউনিয়ন পরিষদে অন্তত ৪৯টিতে চেয়ারম্যান পদে দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী বিজয়ী হয়েছে।
চট্রগ্রাম বিভাগের অন্তর্গত লক্ষ্মীপুর জেলার সভাপতি গোলাম ফারুক পিংকু বলেন, স্থানীয় নির্বাচন সামনে আসলে মনোনয়ন পাওয়া না পাওয়া নিয়ে নেতায় নেতায় দ্বন্দ্ব তৈরি হয়।
কখনও কখনেও পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে একজন আরেকজনের মুখ পর্যন্ত দেখেন না। তিনি আরও বলেন, এক নেতা আরেক নেতার বিরুদ্ধে বিষোদগারও করেন।
মনোনয়ন নিয়ে অসম প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এর ফলে দলে দেখা দেয় সাংগঠনিক দুর্বলতা। তিনি বলেন, দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে সুফলের চেয়ে কুফল বেশি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রংপুর বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত শফিকুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন জেলা-উপজেলার নেতাদের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, স্থানীয় নির্বাচনগুলোই দলের অভ্যন্তরে দলাদলির মূল কারণ।
তিনি বলেন, কথা বলে জেনেছি দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচন চালু হওয়ায় সবাই জনপ্রতিনিধি হতে চান। অযোগ্যরাও নিজেদের যোগ্য মনে করে মনোনয়ন দৌঁড় শুরু করেন।
ফলে এক ধরনের অসম প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এই প্রতিযোগিতায় অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় অযোগ্যরা এগিয়ে যান, যোগ্য ও ত্যাগীরা পিছিয়ে পড়েন। সেখান থেকেও এক ধরনের বিরোধের সূত্রপাত ঘটে।
খুলনার বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেনও একই রকম মন্তব্য করেন। তার মতে, তৃণমূলের ক্ষোভগুলো মূলত স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে।
তিনি বলেন, আগের নিয়মে নির্বাচন হলে সবাই প্রার্থী হওয়ার সুযোগ পেত। যিনি জয়ী হয়ে আসতেন তিনিই রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে বরণীয় হতেন। এখন সেই সুযোগ না থাকায় যোগ্য-অযোগ্য সবাই মনোনয়ন প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন।
তিনি বলেন, এই অসম প্রতিযোগিতায় নেমে অনেক ক্ষেত্রে নব্য রাজনীতিকরা সুযোগ পেয়ে যান। ফলে বিস্তর ক্ষোভ দেখা দেয় সংগঠনের বিভিন্ন সারির নেতাদের মধ্যে। এই বিরোধ সংগঠনকে দুর্বল করে তুলছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান বলেন, দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচন কিছু সুফল আছে। তেমনি কুফলও আছে। অন্যতম কুফল হলো বিদ্রোহী দমনে হিমশিম খেতে হয় আমাদেরকে।
ফারুক খান বলেন, এই বিদ্রোহ থেকেই দ্বন্দ্ব-কোন্দল বাড়তে থাকে। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় নেতাদের সফরে আওয়ামী লীগের প্রথম পদক্ষেপ হলো, এমন ব্যবস্থ্যা করতে হবে যাতে স্থানীয় নির্বাচনে দল মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে দলের অন্য কোনও নেতা বিদ্রোহ প্রকাশ না করে। এই পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে দলাদলি দূর হবে।
টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুর রহমান ফারুক বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হলেও চূড়ান্ত মনোনয়নে দলকে আরও সংবেদনশীল হতে হবে।
প্রকৃতপক্ষে দলের জন্য নিবেদিত কর্মী মনোনয়ন পেলে দলাদলি ক্ষোভ দূর হবে। তিনি বলেন, দলের একজন নিবেদিত কর্মী মনে করেন নির্বাচনে তিনি মনোনয়ন পাননি, কিন্তু একজন যোগ্য নেতা মনোনয়ন পেয়েছেন। এরকম হলে আর কষ্ট পুষে রাখবেন না ওই নেতা।
ঢাকা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম বলেন, দলের ভেতর দ্বন্ধ-কোন্দল ও দলাদলির পেছনে স্থানীয় সরকার নির্বাচনও দায়ী।
তিনি বলেন, এসব নির্বাচনে দল মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ প্রকাশ করে প্রার্থীরা যাতে না দাঁড়ায় সেটি নিশ্চিত করতে চাই।
তিনি বলেন, তৃণমূলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে আমরা বিদ্রোহী প্রার্থী হতে নিরুৎসাহিত করছি। এই কৌশল বাস্তবায়ন করা গেলে দলাদলিও কমে যাবে।