জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমরা প্রথমত বিচার করি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে। সেই হিসেবে তিনি একজন প্রাজ্ঞ-দূরদর্শী রাজনীতিবিদ। বঙ্গবন্ধুর প্রকাশ্য পরিচয় এটিই।
এই পরিচয়ের বাইরে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালিকে আরেকটি দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনায় নেওয়া যায়, তা হলো— লেখক বঙ্গবন্ধু। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী (২০১২)’, ‘কারাগারের রোজনামচা (২০১৭)’ ‘আমার দেখা নয়াচীন (২০২০)’— এই তিনটি গ্রন্থের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর লেখকরূপ আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়ে ওঠে। এ যেন এতদিন গোপনে তালাবদ্ধ থাকা কোনো বদ্ধ কুঠুরির দ্বার উন্মোচন।
বঙ্গবন্ধুর তিনটি বই তিনটি ভিন্ন আঙ্গিকে লেখা। এর মধ্যে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ আত্মজীবনীমূলক লেখা, ‘কারাগারের রোজনামচা’ ডায়েরির আঙ্গিকে লেখা।
অন্যদিকে ‘আমার দেখা নয়াচীন’ কেবল ভ্রমণ কাহিনী নয়, বিশ্লেষণের মাত্রায় একটি ভিন্ন দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক পরিসর দারুণভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে। পাঠক শুধুই ভ্রমণকাহিনী হিসেবে পড়ে শেষ করতে পারবে না। একটি দেশকে নানমাত্রায় জানার ধারণা পাবে।
সৃজনশীল চিন্তার জগৎ বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে পরিব্যপ্ত ছিল। তিনি সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক জগৎটি যেমন অনায়াসে বুঝতেন, তেমনি তার প্রকাশও বক্তৃতায় সহজভাবে করতে পারতেন। (সেলিনা)
ব্যক্তি কিংবা রাজনৈতিক জীবনে যতই প্রতিকূলতা থাকুক না কেন, এই লেখালেখির কাজটি সমানভাবে করে গেছেন বঙ্গবন্ধু। রাজনীতির ফাঁকে ফাঁকে তিনি লিখেছেন, লিখেছেন জেলখানাতে বসেও। আর এই লেখালেখির প্রেরণায় ছিলেন তার স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব।
‘আমার মা সব সময় অনুপ্রেরণা দিতেন তিনি যেন তার জীবনীটা লিখে রাখেন। সেই থেকেই তিনি লিখতে শুরু করেন এবং যতবার কারাগার থেকে তিনি মুক্তি পেতেন, তখন মা জেলগেইটে উপস্থিত থেকে আর কিছু না হোক লেখার খাতাগুলো তিনি সংগ্রহ করে রাখতেন।’ (শেখ হাসিনা: ২০২০)
মোটা দাগে বলা যায়— ইতিবাচক ইতিহাস সৃষ্টিকারী রাষ্ট্রনায়করা রাজনীতির পাশাপাশি সংস্কৃতিমনস্ক লেখক তৈরিতে ভূমিকা রেখেছেন। তারা চর্চা করেছেন রাজনৈতিক মূল্যবোধ ও আদর্শগত তত্ত্ব। সেগুলো প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন লেখালেখিকে। প্রাচীন এথেন্সের রাষ্ট্রনায়ক পেরিক্লিস থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন, টমাস জেফারসন, আব্রাহাম লিংকন, ইংল্যান্ডের উইনস্টন চার্চিল, ভারতের মহাত্মা গান্ধী ও পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা— তারাও লেখালেখি করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তাদের ধারায় নিজেকে বিন্যস্ত করেছিলেন।
তিনি দেখেছেন অত্যাচারী শাসকশ্রেণির শাসনকৌশল, দেশের নিপীড়ন, বঞ্চনা, মানুষকে অধিকার না দেওয়ার নানা কৌশল। এই সব অসঙ্গতিকে রাজনৈতিক বক্তৃতায় যেমন তুলেছেন, লিখেছেন সেগুলোকে বইয়ের পাতাতেও। তাই একে একে প্রকাশিত হয়েছে তার লেখা বই অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা ও আমার দেখা নয়াচীন। এই লেখালেখির মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার মহান নেতা মহাত্মা গান্ধী, পণ্ডিত নেহরু প্রমুখের মতো বঙ্গবন্ধুও নিজের আসন পাকাপোক্ত করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর মানসগঠন সম্পর্কে তাই ড. শামসুজ্জামানের ভাষায় বলা যায়— বঙ্গবন্ধুর মানস নির্মিতির ইতিহাসের দিকে খেয়াল করলে দেখা যায়, তরুণ রাজনৈতিক কর্মী শেখ মুজিব ১৯৩৮ সালে গোপালগঞ্জ সফরে আসা তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক ও শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে আসেন। সেই সূত্রে কলকাতায় তার ছাত্রজীবনে সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের নেতৃত্বে কাজ করার যে সুযোগ অঙ্গীকারদীপ্ত ও প্রতিভাবান শেখ মুজিবের ঘটে, তার বহুমুখী গুরুত্ব ও তাৎপর্য আছে। এই সুবাদে তৎকালীন উপনিবেশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলনের শীর্ষ নেতা মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে যেমন তার সাক্ষাতের সুযোগ হয়, তেমনি সংস্কৃতি ক্ষেত্রের শীর্ষ পুরুষ কবি কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ুন কবির, অধ্যক্ষ ইব্রাহীম খাঁ প্রমুখের সঙ্গেও পরিচয় ঘটে। বিখ্যাত রাজনীতিবিদ ও সাহিত্যিকদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর জীবনের প্রথম পর্বের যে সম্পর্ক স্থাপিত হয়, সেটি তার রাজনৈতিক জীবন গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
অন্যদিকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে দীর্ঘ ও নিরবচ্ছিন্ন সম্পর্ক তাকে পশ্চিমা গণতন্ত্রের ধারারও সমর্থকে পরিণত করে। কেবল এই দুই ধারা নয়, কলকাতায় আবুল হাশিম এবং ঢাকায় মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে রাজনীতি করার সুবাদে বামপন্থী সমাজতান্ত্রিক ধারার প্রতিও বঙ্গবন্ধুর আকর্ষণ সৃষ্টি হয়। এই তিনটি ধারার সমন্বয় সাধনের মাধ্যমেই শেখ মুজিব তার রাজনৈতিক-জীবনকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে মণ্ডিত করেন। অন্য পক্ষে সাহিত্য ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের বিশিষ্টজনের সঙ্গে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও সখ্যের সুবাদে তাঁর রাজনৈতিক চিন্তার সঙ্গে সমন্বয় ঘটে সংস্কৃতিরও। (শামসুজ্জামান: ২০১৮)
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে একাধিকবার কারাগারে যেতে হয়েছে। ৫৪ বছরের জীবনের প্রায় ১২ বছর তাকে কাটাতে হয়েছে কারাগারে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন ও অত্যাচার এই জাঁদরেল নেতার মনোবল ভাঙতে পারেনি। তার রচনাসম্ভার মূলত জেলজীবনেরই সৃষ্টি। একদম আত্মজীবনীর যে ফরম্যাট, তা পুরোপুরি অনুসরণ করেছেন অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে—
‘আমার জন্ম হয় এই টুঙ্গিপাড়া শেখ বংশে। শেখ বোরহানউদ্দিন নামে এক ধার্মিক পুরুষ এই বংশের গোড়াপত্তন করেছেন বহুদিন পূর্বে। শেখ বংশে যে একদিন সুদিন ছিল তার প্রমাণস্বরূপ মোগল আমলের ছোট ছোট ইটের দ্বারা তৈরি চকমিলান দালানগুলি আজও আমাদের বাড়ির শ্রী বৃদ্ধি করে আছে। বাড়ির চার ভিটায় চারটা দালান। বাড়ির ভিতরে প্রবেশের একটা মাত্র দরজা, যা আমরাও ছোট সময় দেখেছি বিরাট একটা কাঠের কপাট দিয়ে বন্ধ করা যেত। একটা দালানে আমার এক দাদা থাকতেন। এক দালানে আমার এক মামা আজও কোনোমতে দিন কাটাচ্ছেন। আর একটা দালান ভেঙে পড়েছে, যেখানে বিষাক্ত সর্পকুল দয়া করে আশ্রয় নিয়েছে। এই সকল দালান চুনকাম করার ক্ষমতা আজ তাদের অনেকেরই নাই। এই বংশের অনেকেই এখন এ বাড়ির চারপাশে টিনের ঘরে বাস করেন। আমি এই টিনের ঘরের এক ঘরেই জন্মগ্রহণ করি।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা-৩)।
শুধু দুই হাত ভরে শুধু লেখেনইনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি পড়েছেনও মন ভরে। ওই সময়ে নামিদামি লেখকদের বই পড়তেন নিয়মিত। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরীসহ বিখ্যাত সাংবাদিকদের রাজনৈতিক কলাম পড়তেন। পাশাপাশি পড়তেন ইতিহাসের বই ও বিপ্লবী সাহিত্য। তার লেখায় পাই—
‘১৭৮৯ সালের ১২ই জুলাই ফরাসি দেশে শুরু হয় বিপ্লব। প্যারিস নগরীর জনসাধারণ সাম্য, মৈত্রী, ও স্বাধীনতার পতাকা হাতে সামনে এগিয়ে যায় এবং গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সূচনা করে। ১৪ ই জুলাই বাস্তিল কারাগার ভেঙে রাজবন্দীদের মুক্ত করে এবং রাজতন্ত্র ধ্বংস করে প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করে। ১৭৭ বছর পরেও এই দিনটি শুধু ফ্রান্সের জনসাধারণই শ্রদ্ধার সাথে উদ্যাপন করে না, দুনিয়ার গণতন্ত্রে বিশ্বাসী জনসাধারণও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে।’ (কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা-১৬১)।
বঙ্গবন্ধুর লেখালেখির মূল প্রেরণা ছিল শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু বলছেন, ‘আমরা যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই এই আমাদের স্লোগান।’
বঙ্গবন্ধুর আরেকটি বই আমার দেখা নয়াচীন। গবেষক পার্থ শংকর সাহা বইটি নিয়ে বলছেন, ‘৩২ বছর বয়সে ১৯৫২ সালে বঙ্গবন্ধু চীনে যান। সেই চীন সফর নিয়ে বইটি লেখা। এই বইয়ে রয়েছে রাজনীতি, অর্থনীতি, বৈষম্য, সামাজিক নানা অনুষঙ্গ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, মানবিক যোগাযোগ, বিশ্ব বাস্তবতা, স্বকীয়তা বজায় রাখার অনবদ্য প্রয়াস, আর অবশ্যই রসবোধ—সব মিলিয়ে বইটি। আছে অকৃত্রিমতা, যা তার রক্তের ভেতরে মিশে আছে। সারা জীবন যা মানুষের ও দেশের জন্য ন্যায্য বলে মনে করেছেন, তা–ই করেছেন। সেখানে কৃত্রিমতা বাসা বাঁধেনি। এই বইয়েও সেই অকৃত্রিমতার এক পরাকাষ্ঠা।’ (পার্থ: ২০২০)
১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে নয়া চীনের পিকিংয়ে এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তদানীন্তন পাকিস্তান প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব বাংলা থেকে শান্তি সম্মেলনে যোগদান করেন।
পূর্ববাংলা থেকে তার ভ্রমণ-সঙ্গী ছিলেন পূর্ববাংলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সহসভাপতি আতাউর রহমান খান, ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস ও ইউসুফ হাসান।
নয়া চীন ভ্রমণ করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু মিয়ানমার, ব্যাংকক ও হংকংও গিয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালে রাজবন্দী থাকাবস্থায় বঙ্গবন্ধু সেই ভ্রমণের সরস বিশ্লেষণ করেছেন ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে।
নয়াচীনের অবিসংবাদিত নেতা মাও সেতুংয়ের প্রতি সে দেশের মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা, নয়াচীনের রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক অবস্থা ও বাস্তবতা বঙ্গবন্ধু এ ভ্রমণে প্রত্যক্ষ করেন।
চীন ভ্রমণের এসব অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেন; যেখানে তিনি তৎকালীন পাকিস্তান ও চীনের রাজনৈতিক-আর্থসামাজিক অবস্থার তুলনা, কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের চর্চা প্রভৃতি বিষয়াদি প্রাঞ্জলভাবে আলোচনা করেন। এটিই বঙ্গবন্ধুর ‘আমার দেখা নয়াচীন’।
চীন দেশ ভ্রমণের ইচ্ছা বঙ্গবন্ধুর আগে থেকেই ছিল। গ্রন্থের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু লিখেছেন— ‘জেলে থাকতে ভাবতাম, আর মাঝে মাঝে মাওলানা ভাসানী সাহেবও বলতেন, যদি সুযোগ পাও একবার চীন দেশে যেও।’
চিয়াং কাইশেকের নির্যাতন-নিপীড়নকে পরাভূত করে চীনের জাতীয়তাবাদী নেতা মাও সেতুংয়ের হাত ধরে নয়া চীনে যে পরিবর্তন সূচিত হয়েছে, ধনী-গরীবের ভিতর যে সমতা এসেছে, একটি শোষণমুক্ত সমাজ গঠিত হয়েছে; তা বঙ্গবন্ধুকে দারুণভাবে আলোড়িত করেছিল। একটি শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের প্রেরণা হয়তো বঙ্গবন্ধু এখান থেকে পেয়েছিলেন, যার ইঙ্গিত এই গ্রন্থে রয়েছে।
নয়া চীনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু গ্রন্থের ৬৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন: ‘আমি লেখক নই, অনুভব করতে পারি মাত্র, লেখার ভিতর দিয়া প্রকাশ করার মতো ক্ষমতা খোদা আমাকে দেন নাই।’
বঙ্গবন্ধু নিজেকে লেখক দাবি না করলেও তার রচিত ‘আমার দেখা নয়া চীন’ গ্রন্থটির প্রাঞ্জল বর্ণনা, জটিল বিষয়বস্তুকে সরলভাবে উপস্থাপন পাঠক-হৃদয়ে ছুঁয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে তার কন্যা শেখ হাসিনা গ্রন্থের ভূমিকাতে লিখেছেন—
‘এই ভ্রমণ কাহিনী অতি প্রাঞ্জল বর্ণনা দিয়ে তিনি পাঠকের জন্য উপভোগ্য করেছেন। প্রতিটি শব্দ, বাক্য রচনার যে পারদর্শিতা আমরা দেখি, তাতে মুগ্ধ হয়ে যাই।’
বাঙালির জীবনে স্বাধীনতার আলোর জন্য বঙ্গবন্ধু নিপতিত হয়েছিলেন পাকিস্তানি কারা-অন্ধকারে। কারা কক্ষেও তিনি খুঁজে ফিরেছেন বাংলা বই ও পত্রিকা। মার্কিন রাষ্ট্রতত্ত্ববিদ, লেখক হেনরি ডেভিড থরোর সুবিখ্যাত রচনা সিভিল ডিসঅ্যাবিডিয়েন্স (১৮৪৯) ছিল বঙ্গবন্ধুর পাঠের আওতায়। এপ্রিল ১৯৬৭-তে তিনি লিখছেন— ‘মনে রেখ থরোর কথা Under a government which imprisons any unjustly, the place for a just man is also a Prison.’ এভাবেই বাংলা ও বিশ্বসাহিত্যের পাতায় পাতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পেয়েছেন চিরকালের মুক্তিপ্রত্যাশী মানুষের দেখা।
আমরা লেখক বঙ্গবন্ধুকে আবিষ্কার করতে পারি পুরনো পত্রিকা পাঠের মাধ্যমে। শুধু বই-ই নয় পত্রিকার পাতাতে কলামও লিখেছেন তিনি। ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৯ সময়কালের মধ্যে দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা পাঁচটি প্রবন্ধের সন্ধান পাওয়া যায়।
‘নেতাকে যেমন দেখিয়াছি’ (ইত্তেফাক, সোহরাওয়ার্দী সংখ্যা, মার্চ ১৯৬৪। ১৩৭৬ সনের ১৯ অগ্রহায়ণ, ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর, শুক্রবার ‘ইত্তেফাক’ পত্রিকায় লেখাটি পুনর্মুদ্রিত হয়) প্রবন্ধে তিনি লিখছেন—
‘১৯৪৬ সালের কলকাতা দাঙ্গার সময় একাকী জনাব সোহরাওয়ার্দী এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গিয়া অসহায় লোকদের সাহায্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যস্ত। হঠাৎ এক সময় তাহার গাড়িতে বোমা নিক্ষিপ্ত হইল এবং উহার বিস্ফোরণও ঘটিল। সামান্য আহত হইলেও তাহাতে জনাব সোহরাওয়ার্দীর কোনো ক্ষতি হলো না। তিনি লাফ দিয়া গাড়ির বাইরে আসিয়া প্রাণে বাঁচিলেন।’ (মুজিব)
এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘শহীদ চরিত্রের অজানা দিক’ (ইত্তেফাক, সোহরাওয়ার্দী সংখ্যা, রবিবার, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৩৭২, ৫ ডিসেম্বর ১৯৬৫), ‘স্মৃতির মিছিল: হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ ‘ (দৈনিক পাকিস্তান, বিশেষ প্রতিনিধি, শুক্রবার, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৩৭৬, ৫ ডিসেম্বর ১৯৬৯।
১৩৭৯ সনের ১৯ অগ্রহায়ণ, ১৯৭২ সালের ৫ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার দৈনিক বাংলার বিশেষ সংখ্যায় পুনর্মুদ্রিত), ‘আমাদের মানিক ভাই’ (ইত্তেফাক, সোমবার, ২৬ জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৬, ৯ জুন ১৯৬৯), ‘আমার মানিক ভাই’ (ইত্তেফাক, বৃহস্পতিবার, ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৯, ১ জুন ১৯৭২। ১৩৮০ সনের ১৮ জ্যৈষ্ঠ, ১৯৭৩ সালের ১ জুন, শুক্রবার ইত্তেফাকের তফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া) স্মৃতিসংখ্যায় পুনর্মুদ্রিত) প্রবন্ধগুলোতেও তার লেখকসত্তার পরিচয় মেলে।
রাজনীতির মানুষ হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের প্রেরণা দিয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের আর লেখালেখির মানুষ হিসেবে তিনি উন্মোচন করেছেন রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও চারপাশের সঙ্গতি-অসঙ্গতির নানা দিক। তাই বঙ্গবন্ধুর নির্মোহ বয়নভঙ্গি সুদৃঢ় করে তার লেখক মহিমা, তার লেখালেখির জগৎ। ৫৫ বছরের জীবন না হলে বঙ্গবন্ধুর আরও লেখক কুঠুরির সন্ধান আমরা নিশ্চয় পেতাম।
লেখক: জয়েন্ট নিউজ এডিটর, সারাবাংলা ডটনেট
তথ্যসূত্র
শেখ মুজিবুর রহমান, নেতাকে যেমন দেখেছি, অনলাইন লিংক: https://songramernotebook.com/archives/115970
বঙ্গবন্ধুকে লিখতে কীভাবে উৎসাহ দিতেন বঙ্গমাতা, জানালেন প্রধানমন্ত্রী, ৭ অক্টোবর ২০২০,
https://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article1808946.bdnews
সেলিনা হোসেন, বঙ্গবন্ধুর লেখক সত্তা
শামসুজ্জামান খান, লেখক বঙ্গবন্ধু, দৈনিক প্রথম আলো, ১৬ মার্চ ২০১৮
শামসুজ্জামান খান, বঙ্গবন্ধুর নতুন বই আমাদের দেখা নয়াচীন,
বই, জানুয়ারি-জুন ২০২০ সংখ্যা, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, ঢাকা
পার্থ শংকর সাহা, বঙ্গবন্ধুর নয়াচীন, দৈনিক প্রথম আলো, ৯ মার্চ ২০২০
মূল বই
অসমাপ্ত আত্মজীবনী, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ২০১২ ঢাকা
কারাগারের রোজনামচা, বাংলা একাডমি, ২০১৭, ঢাকা
আমার দেখা নয়াচীন, বাংলা একাডেমি, ২০২০, ঢাকা