মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বিরোধিতাকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কখনোই বাঙালির উত্থানকে ভালোভাবে মেনে নিতে পারেনি। তারা উগ্রবাদীদের মদত দিয়ে, এই দেশকে আফগানিস্তান-পাকিস্তানের মতো ধ্বংসস্তুপে পরিণত করতে চেয়েছিল।
সেটি সম্ভব হলে, তারা আমাদের সার্বভৌমত্বকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে, জঙ্গি দমনের নামে যখন তখন তাদের বহর নিয়ে এই ভূখণ্ডে ঢুকতো; ইচ্ছামতো অভিযান চালাতো, প্রাকৃতিক সম্পদ লুটপাট করে নিয়ে চলে যেতো। কিন্তু তারা সেটি করতে ব্যর্থ হয়েছে। তবে তারা কখনোই হাল ছাড়েনি।
সাম্প্রতিক কালেও আমাদের অগ্রযাত্রাকে দমিয়ে রাখার জন্য নিয়মিত ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে আমেরিকা। তবে তাদের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেই, প্রমত্ত পদ্মা নদীর বুকে দ্বিতল বিশিষ্ট বহুমুখী সেতু নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ। আগামী জুন মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হওয়ার কথা রয়েছে এই সেতুর।
তাহলে দেশের দক্ষিণপশ্চিম অঞ্চলের প্রায় ৪৪ হাজার বর্গকিলোমিটার ভূখণ্ড রাজধানীর সঙ্গে যুক্ত হবে। এই সেতু দিয়ে গ্যাস, বিদ্যুৎ, ফাইবার অপটিক সংযোগের সঙ্গে যুক্ত হবে প্রায় ৩ কোটি মানুষ।
সড়ক ও রেল সংযোগের কারণে বাড়বে ব্যবসা বাণিজ্য। ফলে গতি আসবে অর্থনীতিতে। এই সেতুর কারণে দেশের জিডিপি বাড়বে প্রায় ১.২ থেকে দেড় শতাংশ পর্যন্ত।
নিজেদের অর্থে এই সেতু নির্মাণের কারণে সারা বিশ্ব বাহবা দিচ্ছে বাংলাদেশকে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এই সেতু হয়েছে অনেকটা চপেটাঘাতের মতো।
কারণটা হলো, এই সেতুর জন্য যে বিশ্ব-ব্যাংকের যে ঋণ দেওয়ার কথা ছিল। আমেরিকার কারণে তা বাতিল করে দেয় তারা। তাদের ধারণা ছিল, দুর্নীতির অভিযোগ তুলে আর্থিক সমর্থন বাতিল করলে, বাংলাদেশ আর এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারবে না। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশকে হেয় করার জন্য তারা কিন্তু কানাডার আদালতে মামলাও করেছিল এ বিষয়ে।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের এই ষড়যন্ত্রকে পাত্তা দিলেন না। কারণ, ১৯৯৬ সালে সরকারে এসেই, দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভূমিকে রাজধানীর সঙ্গে সরাসরি সংযোগের পরিকল্পনা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সব সম্ভাবত্য ও জরিপ সম্পন্ন করে, মাওয়াপ্রান্তে সেতুর ভিত্তি স্থাপন করেন ২০০১ সালের ৪ জুলাই। কিন্তু এরপর ক্ষমতার পালাবদল হলে, পদ্মা সেতুর ব্যাপারে আর কোনো আগ্রহ দেখায়নি বিএনপি।
বিশ্বের অন্যতম স্রোতবাহী নদীর ওপর ছয় কিলোমিটারের বেশি দৈর্ঘের একটা দুই-তলা সেতুর কথা অবাস্তব মনে হয়েছিল তাদের কাছে।
তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠনের পর, ছয় মাসের মধ্যে মন্ত্রিসভায় পদ্মা সেতুর নকশা অনুমোদন করে। চলতে থাকে গ্রাউন্ডওয়ার্ক। সব সবকিছু গোছানো শেষ। শুধু কাজ শুরু হবে। এমন একটা সময়ে, ২০১২ সালে হুট করেই দুর্নীতির ধুয়া তুলে প্রকল্প থেকে সরে যায় বিশ্বব্যাংক।
যদিও তারা একটা পয়সাও দেয়নি তখনো, তারপরেও আমেরিকার নির্দেশে এক কল্পিত দুর্নীতির অভিযোগ তুলে এই প্রকল্পকে বানচালের চেষ্টা করে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর পিছু হঠতে চাইলেন না। তিনি তখন নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিলেন। এরপর ২০১৪ সালের ১৭ জুন, সেতুর মূল অবকাঠামো নির্মাণের জন্য আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয় চীনের মেজর ব্রিজ কোম্পানির সঙ্গে। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর সেতুর মূল অবকাঠানো নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।
এদিকে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে, বিশ্বব্যাংকের সেই কল্পিত দুর্নীতির অভিযোগ কানাডার আদালতেও খারিজ হয়ে যায়। পরবর্তীতে, ২০১৯ সালের ৯ অক্টোবর, বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট হার্টভিগ শ্যাফার বাংলাদেশে এসে তাদের ভুল স্বীকার করেন।
ততদিনে চীনের প্রযুক্তিগত সহযোগিতা ও নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতুর কাজ অনেকখানি এগিয়ে গেছে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্কটাকেও সহ্য করতে পারছিল-না আমেরিকা। যেকারণে করোনা মহামারির মধ্যেও তারা বাংলাদেশকে নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে নিয়মিত নেতিবাচক অপপ্রচার চালিয়েছে। তবে সেটাতেও তারা ব্যর্থ হয়েছে।
যাই হোক, সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে, করোনার মধ্যেই, ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বরে, পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামোর কাজ শেষ হয়ে যায়। এরপর কার্পেটিংসহ অন্যান্য কাজ চলছে এখন। আশা করা যাচ্ছে এবছর জুনের মধ্যেই চালু হয়ে যাবে পদ্মা সেতু।
পুরো বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু আমাদের এই উত্থান সহ্য হচ্ছে না আমেরিকানদের। তাই নতুন করে বাংলাদেশকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা করছে তারা। এর অংশ হিসেবেই সম্প্রতি (১০ ডিসেম্বর, ২০২১), র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তারা।
এর আগেও বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প যখন বিশ্বব্যাপী ডালপালা ছড়াতে শুরু করেছিল, এই খাত থেকে দেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা শুরু করলো, ঠিক তখনই ২০১৩ সালের শেষে দিকে বাংলাদেশের জিএসপি (শুল্ক মুক্ত পণ্য রফতানি) সুবিধা বাতিল করলো যুক্তরাষ্ট্র।
যাতে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর একটা ধাক্কা দেওয়া যায়, এটাই ছিল মূলত উদ্দেশ্য। স্বাধীনতা থেকে শুরু করে- বাংলাদেশের কোনো উন্নয়ন, অগ্রযাত্রাই তারা কখনো মেনে নিতে পারে নি। করোনার মধ্যে আমেরিকায় লাখ লাখ মারা গেছে, তবে বাংলাদেশ অনেক ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়ার পরেও সরকারের সতর্কতার কারণে তা মোকাবিলা করতে পেরেছে। সেটাও সহ্য হয়নি আমেরিকার। আর পদ্মা সেতু তো তাদের জন্য একটা বিরাট ধাক্কা।
পদ্মা সেতু কেনো অন্য যেকোনো সেতুর থেকে আলাদা, সেটা বলছি- কারণটা হলো নদীর প্রকৃতি। পদ্মা নদীর তলদেশের গভীরতা অনেক, এছাড়াও সেখানকার মাটির প্রকৃতিও ভিন্ন ধরনের। অতিরিক্ত নরম ও স্রোতের কারণে গতিশীল হওয়ায় সেই মাটিতে পিলার গাঁথা অসম্ভব। ফলে নদীর তলদেশে কৃত্রিম প্রক্রিয়ায় ক্যামিক্যালের সাহায্যে নতুন মাটি তৈরি করে, পিলার গাঁথা হয়।
‘স্ক্রিন গ্রাউটিং’ নামের এই পদ্ধতি ব্যবহার করে বসানো হয় পদ্মা সেতু। এরকম পদ্ধতির ব্যবহারের নমুনা বিশ্বে তেমন একটা নেই। ফলে এতো প্রতিকূলতা অতিক্রম করে এই সেতু বাস্তবায়ন করাটাকে বাংলাদেশের শক্তি প্রদর্শনের একটা মহড়া হিসেবে নিয়েছে আমেরিকা। ফরে ক্ষুব্ধ তারা।
আর তাদের কিছু দোসর আছে বাংলাদেশে। তারাও নিয়মিত পুস করছে মার্কিন প্রশাসনকে। ফলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নিয়মিত লেগে আছে তারা। এখণ তাদের মূল লক্ষ্য আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশকে হেয় করা, যাতে এই অদম্য সাফল্যগুলো আড়ালে চলে যায়।
এক্ষেত্রে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, হিলারি ক্লিনটনের বন্ধু ড. ইউনুস ও আমেরিকার দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত এজেন্ট রেজা কিরবিয়ার কথা বলতেই হবে। কারণ, গার্মেন্টস শিল্পকে ধ্বংসের জন্য আমেরিকাকে জিএসপি বাতিল করতে ২০১৩ সালের ৩০ জানুয়ারিতে চিঠি লিখেছিলেন খালেদা জিয়া।
তা প্রকাশিত হয় ওয়াশিংটন টাইমস পত্রিকায়। খালেদার লক্ষ্য ছিল, জিএসপি বাতিল হলে গার্মেন্টস শিল্পে ধস নামবে। শ্রমিকরা আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ হবে। তাহলে উগ্রবাদীদের সহায়তায় সরকার দখল করবেন তিনি।
খালেদা জিয়ার পরামর্শে আমেরিকা ঠিকই শ্রমিকদের পেটে লাথি দিয়ে জিএনপি বাতিল করলো। তবে সরকার বিকল্প অনেক কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করায়, শ্রমিকরা নিজেদের কর্মসংস্থান জোগাড় করতে সমর্থ হয়। ফলে বাংলাদেশের সরকার বদলের জন্য আমেরিকার এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।
এদিকে ২০০৭-০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আমেরিকার সাহায্যে দেশের ক্ষমতায় বসার চেষ্টা করছিলেন ড. ইউনুস। মূলত, সাবেক মার্কিন ফার্স্টলেডি হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে বন্ধুত্বকে ব্যবহার করে, পশ্চিমা বিশ্বে নিয়মিত দেশবিরোধী অপপ্রচার চালিয়ে গেছেন তিনি।
ক্ষুদ্র ঋণের নামে গরিব মানুষদের রক্ত শুষে খাওয়ার থিউরি দেওয়ার জন্য এই ইউনুসকে নোবেল দিয়েছে পশ্চিমারা। করোনার মতো মহামারিতেও এই নোবেল-জয়ীকে কিন্তু গণমানুষের পাশে দেখা যায়নি, অথচ তিনি নিয়মিতই পশ্চিমাদের পারপাস সার্ভ করে যাচ্ছেন। সম্প্রতি রেজা কিরবিয়াকেও অনেক হম্বি-তম্বি করতে দেখা যাচ্ছে।
এর কারণটাও ফাঁস হয়ে গেছে। পেছনে আছে আমেরিকা। ২০০৬ সালে আমেরিকার কর্মকর্তাদের কাছে বাংলাদেশের ব্যাপারে হস্তক্ষেপের সুপারিশ জানিয়েছিলেন তিনি।
তিনি চেয়েছিলেন, সামরিক অভিযানের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোকে শেষ করে দেওয়া হোক। তারপর ড. কামালদের সঙ্গে নিয়ে তারা দেশের ক্ষমতা দখল করবেন। উইকিলিকসের ফাঁস করা আমেরিকার কর্মকর্তাদের ইমেইল থেকে এসব তথ্য বের হয়ে গেছে।
এদিকে ইদানিংকালে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণার জন্য বিএনপি মহাসচিবের সঙ্গে আমেরিকার একটি লবিস্ট ফার্মের চুক্তিও ফাঁস হয়েছে। প্রথমে অস্বীকার কররেও, একটি সংবাদ সম্মেলনে এই কথা স্বীকারও করেছেন ফখরুল। তারা আসলে কী চাচ্ছে? আমেরিকাকে তারা বলেছে যে, আমেরিকার স্থায়ী স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য তারা প্রস্তুত।
এরপর, আমেরিকাকে আমাদের সমুদ্রে আসার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে। আর আমেরিকার তো আগ্রহের শেষ নেই বাংলাদেশের ব্যাপারে। ভৌগলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই দেশে একবার ঢুকতে পারলে, তারা এখানে ঘাঁটি গেড়ে বসে যাবে।
সুতরাং আমেরিকাও নিয়মিত বাংলাদেশকে বিতর্কিত করার জন্য লেগেই আছে! কারণ দেশের ভেতরের মীরজাফরেরা আমেরিকার কাছে দেশবিক্রির প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে!!
সূত্র: ঢাকা টেলিভিশন