অনলাইন ডেস্ক: কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে ৪ লেন বিশিষ্ট সড়ক টানেল নির্মিত হচ্ছে যার নাম ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’। দেশের প্রথম এই টানেল নির্মিত হচ্ছে চীনের আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায়।
২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিন পিং এর ঢাকা সফরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণে ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর হয়। চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন এ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি) এই টানেল নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
চট্টগ্রাম শহরপ্রান্তের নেভাল একাডেমির পাশ দিয়ে শুরু হওয়া এই টানেল নদীর দক্ষিণ পাড়ের আনোয়ারা প্রান্তের চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড এবং কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার লিমিটেড কারখানার মাঝামাঝি স্থান দিয়ে নদীর দক্ষিণ প্রান্তে পৌঁছাবে। কর্ণফুলী নদীর মধ্যভাগে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল অবস্থান করবে ১৫০ ফুট গভীরে।
চুক্তি অনুযায়ী টানেল নির্মাণে ব্যয় হবে ৯ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা, যার মধ্যে চীনের এক্সিম ব্যাংক ২০ বছর মেয়াদি ঋণ হিসাবে ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা দিচ্ছে যার সুদের হার ২ শতাংশ। বাকি ৩ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকারের অর্থ সহায়তা । নদীর তলদেশে নির্মিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেল এটি।
২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিন পিং প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এরপর ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল এর প্রথম টিউবের বোরিং কাজ উদ্বোধন করেন। পরবর্তীতে ২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দ্বিতীয় টিউবের কাজ উদ্বোধন করেন।
কর্ণফুলীর দুই তীরকে সংযুক্ত করে চীনের সাংহাই শহরের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ মডেলে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কে সংযুক্তির উদ্দেশ্যে এ টানেল নির্মাণ করা হচ্ছে।
টানেলের মোট দৈর্ঘ্য হবে প্রায় 9.092 কিলোমিটার যার মধ্যে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে 3.40 কিলোমিটার, আর 4.89 কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ রোডের পাশাপাশি 740 মিটার সেতু এবং কর্ণফুলীর পশ্চিম দিকে ভারী শিল্প-কারখানার সাথে সংযোগ স্থাপন করা হবে।
টানেল টিউবের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার এবং ভেতরের ব্যাস ১০ দশমিক ৮০ মিটার। মাল্টিলেন টানেলটি সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দর ও দক্ষিণ চট্টগ্রাম বিশেষ করে আনোয়ারা উপজেলাকে সংযুক্ত করবে। এতে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যে যোগাযোগ সহজ হবে।
এরই মধ্যে নদীর তলদেশে 11 মিটার ব্যবধানে স্থাপন করা হয়েছে দুটি টিউব। টিউব দুটি তৈরি করা হয়েছে যাতে ভারী যানবাহন সহজেই টানেলের মধ্য দিয়ে যেতে পারে। তাছাড়া একটি টিউবে কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে যাতে বিকল্প পথে গাড়ি চালানো যায়, সেটিরও কাজ চলছে। এদিকে টানেলের নিরাপত্তায় নতুন করে স্ক্যানার মেশিন বসানো হচ্ছে।
Hardware স্থাপন এবং বিবিএ বিল্ডিং নেটওয়ার্কিং এর কাজ সম্পন্ন হয়েছে। Software Customization এর কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ট্রেনিং কার্যক্রম চলমান আছে। টানেলের পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে মোট নির্মাণ করা হয়েছে প্রায় ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ সড়ক, ৭৭২ মিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভার।
আনোয়ারা প্রান্তে ৭২৭ মিটার Viaduct -এর ডেক স্লাব ও pavement নির্মাণ কাজ (১০০%) সম্পন্ন হয়েছে। ইতোমধ্যে ২৪৫০ মিটার দৈর্ঘের একটি টানেল টিউব এর রিং প্রতিস্থাপন সহ বোরিং এর কাজ বিগত ২ অগাস্ট ২০২০ তারিখে সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমানে উক্ত টানেল টিউবের প্রয়োজনীয় Internal Structure নির্মাণ এর কাজসমূহ চলমান রয়েছে।
অদ্যাবধি প্রায় ২৪২৫.০ মিটার (৯৮.৯৭%) Lane Slab – ঢালাইয়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। গত ০৭ অক্টোবর, ২০২১ তারিখে দ্বিতীয় টানেল টিউব এর রিং প্রতিস্থাপনসহ ১০০% বোরিং কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ইতোমধ্যে টানেল বোরিং মেশিনের dismantling কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
Lane Slab – ঢালাইয়ের কাজ অতিশীঘ্রই শুরু হবে। চীনের জিয়াংসু প্রদেশের জেংজিয়াং শহরে টানেল সেগমেন্ট কাস্টিং প্ল্যান্টে ১৯,৬১৬ টি সেগমেন্টের সবকটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করতঃ ১৯,৬১৬ টি (১০০%) সেগমেন্ট চট্টগ্রাম সাইটে পৌঁছেছে। তন্মধ্যে ৯৭৮৪ টি সেগমেন্ট নির্মাণধীন প্রথম টিউবে এবং ৯৮৩২ টি সেগমেন্ট দ্বিতীয় টিউবে সর্বমোট ১৯৬১৬ (১০০%) প্রতিস্থাপন সম্পন্ন হয়েছে।
বাতি ও পাম্প স্থাপন, ড্রেনেজ ব্যবস্থা তৈরির কাজও সমানতালে চলছে। এখন চলছে টানেলের ভেতরে ফায়ার ফাইটিং, লাইটিং ও কন্ট্রোল ব্যবস্থাপনার কাজ। পরীক্ষামূলকভাবে চালানো হচ্ছে প্রকল্পের গাড়িও।
নদীর তলদেশে হওয়ায় যেকোনও সময় পানি জমতে পারে আশঙ্কায় টানেলের মধ্যে বসানো হচ্ছে ৫২টি সেচ পাম্প। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। টানেল চালু হলে কর্ণফুলী নদী পাড়ি দিতে সময় লাগবে মাত্র ৫ থেকে ৬ মিনিট। সময় বেঁচে যাওয়ায় অর্থনীতি গতি পাবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল কে কেন্দ্র করে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড়ে আনোয়ারায় গড়ে উঠেছে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড)। এ টানেলের মধ্যদিয়ে দুই পাড়ের সেতুবন্ধন রচিত হবে।
শিল্পায়নের ফলে এ অঞ্চলের লাখো মানুষের ভাগ্য বদলে যাবে। ফলে ভ্রমণ সময় ও খরচ হ্রাস পাবে এবং পূর্বপ্রান্তের শিল্পকারখানার কাঁচামাল ও প্রস্তুতকৃত মালামাল চট্টগ্রাম বন্দর, বিমানবন্দর ও দেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে পরিবহন প্রক্রিয়া সহজ হবে।
৭৮৩ একর জমি নিয়ে আনোয়ারায় চায়না ইকোনোমিক জোন স্থাপিত হচ্ছে। উক্ত এলাকায় চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানীর ১৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হবে। এখানে রপ্তানিমুখি জাহাজ শিল্প, ইলেকট্রনিক্স পণ্য, ফার্নেশ ও সিমেন্ট শিল্প সহ বিভিন্ন শিল্প কারখানা স্থাপিত হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মিত হলে প্রকল্প এলাকার আশে পাশে শিল্পোন্নয়ন, পর্যটন শিল্পের বিকাশ এবং সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে । ফলে দারিদ্র দূরীকরণসহ দেশের ব্যাপক আর্থসামাজিক উন্নয়ন সাধিত হবে ।
DPP মোতাবেক এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে Financial এবং Economic IRR এর পরিমাণ দাঁড়াবে যথাক্রমে ৬.১৯% এবং ১২.৪৯%। তাছাড়া, Financial ও Economic “Benefit Cost Ratio (BCR)” এর পরিমাণ দাঁড়াবে যথাক্রমে ১.০৫ এবং ১.৫০।
এছাড়াও টানেলকে ঘিরে পর্যটন, শিল্পায়নসহ অর্থনীতিতে যোগ হচ্ছে নতুন মাত্রা। বিভিন্ন ধরনের ২৩টি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও ৩টি বড় কোম্পানী, গায়া প্রোডাক্ট ডেভেলাপমেন্ট কোম্পানী ও ডেইগু প্রোডাক্ট ডেভেলাপমেন্ট কোম্পানী তাদের ইউনিট স্থাপনের কাজ শুরু করেছে। আশা করা যায় রপ্তানিমুখি জুতা, তৈরি পোশাক শিল্প, টেক্সটাইল সহ নানা উৎপাদনমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠান উক্ত এলাকায় স্থাপিত হবে।
তাছাড়া চট্টগ্রাম শহর এড়িয়ে যোগাযোগ–সুবিধার কারণে শিল্পকারখানার কাঁচামাল যেমন সহজে আনা-নেওয়া করা যাবে, তেমনি প্রস্তুত–পণ্যও সারা দেশে খুব সহজে নেওয়া যাবে টানেলের মাধ্যমে। টানেলের কারণে অর্থনৈতিক কার্যক্রম বিস্তৃত হবে।
এ ছাড়া টানেলের কারণে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণপাড়ে বন্দরের কয়েকটি জেটি নির্মাণের সম্ভাবনা তৈরি হলো। এতে বন্দরের সক্ষমতাও বাড়বে। টানেল চালু হলে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হবে শূন্য দশমিক ১৬৬ শতাংশ।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের ভেতর চলতে হলে কোন গাড়িকে কত টোল দিতে হবে, তার একটি তালিকা নির্ধারণ করেছে। এই তালিকা অনুযায়ী গাড়িভেদে ২০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা দিতে হবে।
সেতু কর্তৃপক্ষের নির্ধারণ করা টোল অনুযায়ী, টানেলের মধ্য দিয়ে যেতে হলে প্রাইভেট কার, জিপ ও পিকআপকে দিতে হবে ২০০ টাকা। মাইক্রোবাসের জন্য দিতে হবে ২৫০ টাকা।
৩১ বা এর চেয়ে কম আসনের বাসের জন্য ৩০০ এবং ৩২ বা তার চেয়ে বেশি আসনের জন্য ৪০০ টাকা টোল দিতে হবে। ৫ টনের ট্রাকে ৪০০ টাকা, ৫ থেকে ৮ টনের ট্রাকে ৫০০ টাকা, ৮ থেকে ১১ টনের ট্রাকে ৬০০ টাকা টোল দিতে হবে।
ট্রেইলরের (চার এক্সেল) টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০০ টাকা। চার এক্সেলের বেশি হলে প্রতি এক্সেলের জন্য দিতে হয় ২০০ টাকা করে। সেতু কর্তৃপক্ষের প্রস্তাবিত টোলের এই হার এখনো প্রস্তাবিত। এটিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাগবে।
আইন মন্ত্রণালয় ভেটিং করবে। এরপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনুমোদনের পর চূড়ান্ত করা হবে। এর মধ্যে টোলের হার পরিবর্তন হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের সম্ভাব্যতা সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, টানেল চালু হওয়ার পর ২০২৫ সালে গড়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলাচল করবে।
এ ছাড়া ২০৩০ সালে যানবাহন চলাচলের প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩৭ হাজার ৯৪৬টি এবং ২০৬৭ সালে যানবাহনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রতিদিন গড়ে ১ লাখ ৬২ হাজার।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল শুধু চট্টগ্রামের জন্য নয় গোটা দেশের অর্থনৈতিতে বৈপ্লবিক সাড়া জাগাবে। দেশ যুক্ত হবে এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে। কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের ফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে এবং এশিয়ান হাইওয়ের সাথে সংযোগ স্থাপিত হবে।
ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হবে। কর্ণফুলী নদীর পূর্বপ্রান্তের প্রস্তাবিত শিল্প এলাকার উন্নয়ন ত্বারান্বিত হবে এবং পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত চট্টগ্রাম শহর, চট্টগ্রাম বন্দর ও বিমানবন্দরের সাথে উন্নত ও সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপিত হবে। কর্ণফুলী নদীর পূর্ব প্রান্তের সাথে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপনের ফলে পূর্বপ্রান্তে পর্যটনশিল্প বিকশিত হবে।
লেখক: সহকারী তথ্য অফিসার, পিআইডি ফিচার।