জিয়াউর রহমান বলতে আমরা যে ভারত বিরোধী একজন মানুষ কে চিনি ভারতীয় কূটনৈতিকদের বরাত দিয়ে এমন তথ্য কিন্তু পাওয়া যায় না।
তাকে ভারত অনেক এর চেয়ে বেশি বিশ্বাস করতো তার কার্যকলাপ এর জন্য। এমন কি তার সময় বাংলাদেশ ভারত এর কাছে গ্যাস বিক্রি করতেও রাজি হয়ে গিয়েছিলো।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়াউর রহমান ভারতে দুটি রাষ্ট্রীয় সফর করেছিলেন, আর দুটোতেই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছিল বলে জানাচ্ছেন দিল্লিতে পর্যবেক্ষক ও সাবেক কূটনীতিবিদরা।
জিয়াউর রহমানের আমলে ঢাকায় ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ছিলেন যিনি, সেই মুচকুন্দ দুবে বিবিসিকে এ কথাও বলেছেন যে ১৯৮০তে তার দিল্লি সফরের পর বাংলাদেশ ভারতকে প্রাকৃতিক গ্যাস বেচতেও রাজি হয়ে গিয়েছিল – শুধু বাকি ছিল দাম নিয়ে রফা।
তার আগে ১৯৭৭য়ে জিয়াউর রহমানের ভারত সফরের ঠিক আগেই স্বাক্ষরিত হয়েছিল ফারাক্কা নিয়ে অন্তর্বর্তী একটি সমঝোতা, যা পরে গঙ্গা চুক্তির ভিত গড়ে দেয়।
দিল্লিতে মোরারাজি দেশাই ও ইন্দিরা গান্ধীর আমলে তাঁর সেই দুটো সফরের দিকেই ফিরে তাকানো হয়েছে এই প্রতিবেদনে।
বস্তুত, বাংলাদেশে ভারত-বিরোধী রাজনীতির জন্য দীর্ঘদিন পরিচিত ছিল যে রাজনৈতিক দল, সেই বিএনপির প্রতিষ্ঠা জিয়াউর রহমানের হাতেই।
অথচ দিল্লিতে সাবেক কূটনীতিবিদদের বিশ্বাস, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনি কিন্তু শুধু বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা নয়, বরং একটা বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গী নিয়েই চলতেন।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়াউর রহমান যখন ৭৭-র ডিসেম্বরে প্রথমবার দিল্লিতে পা রাখেন, তখন ভারতে প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের সরকার ক্ষমতায়।
প্রোটোকল ভেঙে প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই ও রাষ্ট্রপতি নীলম সঞ্জীব রেড্ডি দুজনেই তাকে স্বাগত জানাতে দিল্লির বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন।
দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তখন বাংলাদেশ বিভাগের দায়িত্বে তরুণ কর্মকর্তা মুচকুন্দ দুবে।
মি. দুবে বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “বাস্তববাদী জিয়াউর রহমানকে ভারতও কিন্তু বিশ্বাস করত।”
“পরের দিকে ভারত সরকার মনে করতো তাঁর স্ত্রী খালেদা জিয়া পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলেছিলেন। কিন্তু জিয়া কোনওদিন তা করেননি বলেই ভারতের ধারণা ছিল।”
“স্বল্পবাক, সামরিক শৃঙ্খলায় মোড়া মানুষটি ভারতের প্রধানমন্ত্রীদের সঙ্গে সব সময় উচিত ব্যবহার করেছেন – এবং তার সময়ে কাজ হত।”
“পাশাপাশি তিনি যে একটি সার্বভৌম দেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন সফরে সেটা সব সময় খেয়াল রাখতেন, নিজের ও নিজ দেশের আত্মমর্যাদা নিয়েও ছিলেন অত্যন্ত সচেতন।”
সাতাত্তরের সেই সফরের প্রাক্কালেই সই হয়েছিল ফারাক্কা নিয়ে একটি অন্তর্বর্তী সমঝোতা – যার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই জিয়াউর রহমান গঙ্গার জলের ন্যায্য ভাগ নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে সরব হতে শুরু করেন।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ জয়ন্ত কুমার রায় ফারাক্কা চুক্তি নিয়ে তাঁর গবেষণাপত্রে লিখেছেন, সাতাত্তরের এপ্রিল মাসে তদানীন্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম ঢাকায় গিয়ে জিয়াউর রহমানকে ব্যক্তিগতভাবে আশ্বাস দিয়ে আসার ফলেই তখন ওই চুক্তি করা সম্ভব হয়েছিল।
অধ্যাপক রায়ের কথায়, “ভারতের বিশেষজ্ঞ ও আমলাদের সঙ্গে কোনও পরামর্শ না করেই জগজীবন রাম সে দিন কথা দিয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশের দাবির প্রায় পুরোটাই মেনে নেওয়া হবে।”
আসলে সাতাত্তরে স্বাধীন ভারতে জনতা পার্টির নেতৃত্বে প্রথম অকংগ্রেসি সরকার ক্ষমতায় আসার পরই ফারাক্কা নিয়ে জিয়াউর রহমানের দাবি মেটার পথ প্রশস্ত হয়েছিল, বিবিসিকে বলছিলেন দিল্লির একটি নামী স্ট্র্যাটেজিক থিঙ্কট্যাঙ্কের বাংলাদেশ গবেষক স্ম্রুতি পট্টনায়ক।
ড: পট্টনায়কের কথায়, “ফারাক্কা চুক্তিকে জিয়াউর রহমানের জন্য একটি অতি উল্লেখযোগ্য সাফল্য বলেই ধরা হয়।”
“দিল্লিতে আসার আগে কলম্বোর নির্জোট শীর্ষ সম্মেলনে ও জাতিসংঘে – দু`জায়গাতেই তিনি ফারাক্কার প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। জাতিসংঘে বিষয়টা তোলার পর ভারত বলেছিল ঠিক আছে, বিষয়টা আমরা দ্বিপাক্ষিক পর্যায়ে মিটিয়ে নেব।”
“পাশাপাশি মোরারাজি দেশাই ভারতে ক্ষমতায় আসার পর জিয়াউর রহমান সেটাকে একটা নন-আওয়ামী লীগ সরকারের নন-কংগ্রেসি সরকারের সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ হিসেবেই দেখেছিলেন।“
“কারণ মুক্তিযুদ্ধের সময় কংগ্রেস আর আওয়ামী লীগ তো একসঙ্গেই পথ হেঁটেছিল … এই বিষয়টাও ছিল।”
`ইন্ডিয়া টুডে` ম্যাগাজিনের হয়ে ওই সফর কভার করতে গিয়ে দিল্লিতে সাংবাদিক মম্দিরা পুরী আবার লিখেছেন, বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের বিষয়টিও মোরারজি দেশাই সফররত প্রেসিডেন্টের কাছে তুলেছিলেন।
তার সেই রিপোর্ট বলছে, “বাংলাদেশে রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীরা, সে দেশের ভারতপন্থী নাগরিকরা ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষরা যে চরম অত্যাচারিত হচ্ছেন সে খবরও দিল্লিতে আসছিল।“
এরপর যখন আশি সালের জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট জিয়া আবার সংক্ষিপ্ত সফরে সস্ত্রীক দিল্লিতে এলেন, তখন ভারতে সদ্য ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে – আবারও দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন ইন্দিরা গান্ধী।
সেই সফরেও অভিন্ন জলসম্পদের উপযুক্ত বন্টন নিয়ে দুদেশের কথা হয়েছিল – শুরু হয়েছিল একটি সহযোগিতামূলক ফ্রেমওয়ার্ক বা কাঠামো তৈরির কাজও।
একুশে জানুয়ারি, ১৯৮০-তে রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রেসিডেন্ট জিয়ার সম্মানে দেওয়া ব্যাঙ্কোয়েটে ভারতের রাষ্ট্রপতি সঞ্জীব রেড্ডি বলেছিলেন, “ভারত ও বাংলাদেশের মতো কৃষিনির্ভর দেশের অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার হল জলসম্পদের উপযুক্ত সদ্ব্যবহার।”
জলবন্টনের ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও তখনই কিন্তু কার্যত হিমঘরে চলে গিয়েছিল ইন্দিরা ও শেখ মুজিবের মধ্যে বাহাত্তরে সই হওয়া `মৈত্রী চুক্তি`।
স্ম্রুতি পট্টনায়কের কথায়, “মুজিব-ইন্দিরার স্বাক্ষরিত ওই চুক্তিতে খুব পরিষ্কারভাবে `মিউচুয়াল সিকিওরিটি` বা পারস্পরিক নিরাপত্তার কথা বলা হয়েছিল।”
“অর্থাৎ চুক্তিতেই বলা ছিল বাংলাদেশের যে কোনও বিপদে ভারতের সেনা এগিয়ে যাবে, আবার ভারতের বিপদেও বাংলাদেশ পাশে দাঁড়াবে।”
“মিলিটারি ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা জিয়াউর রহমান কিন্তু চুক্তির এই ধারাটাকে খুব ভালভাবে নিতে পারেননি।”
“তাঁর মনে হয়েছিল, এর মাধ্যমে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে ভারত পেছনে ঠেলে দিতে চাইছে। ফলে ওই চুক্তি নিয়ে তিনি বিশেষ এগোতে চাননি।”
দেশের সেনাবাহিনীর ভূমিকা গৌণ হয়ে যাবে এটা জিয়াউর রহমান মেনে নিতে না-পারলেও ভারতকে প্রাকৃতিক গ্যাস বেচার প্রস্তাবে জিয়াউর রহমান কিন্তু সায় দিয়েছিলেন আশির সেই সফরেই।
ততদিনে মুচকুন্দ দুবে ঢাকায় ভারতের হাই কমিশনারের পদে।
মি. দুবে বলছিলেন, “গ্যাস বিক্রির সব কথাবার্তা কিন্তু পাকা হয়ে গিয়েছিল, শুধু দামটা ছাড়া।”
“একাশিতে জিয়াকে যখন হত্যা করা হয়, তখন ওই দাম নিয়েই আলোচনা চলছিল। কিন্তু তাঁর হত্যার পর সব ভেস্তে যায়।”
“তার আগে কী পরিমাণ গ্যাস রপ্তানি হবে, কোথায় কারা পাইপলাইন বসাবে সব ঠিক হয়ে গিয়েছিল।”
“তখন তো আজকের মতো মুক্ত বাজার ছিল না, জিয়া চাইছিলেন বাজারদরে গ্যাস বেচতে, যেটা নিরূপণ করা কঠিন ছিল – আর আমরা বলছিলাম কস্ট প্লাস ফর্মুলায় দ্বিপাক্ষিক ভিত্তিতে গ্যাসের দাম ঠিক হোক।”
এর মধ্যেই ১৯৮১ সালের ৩০শে মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে আততায়ীদের গুলিতে নিহত হন জিয়াউর রহমান।
ঠিক তার আগে বঙ্গোপসাগরে নতুন জেগে ওঠা `দক্ষিণ তালপট্টি` নামের একটি দ্বীপকে ঘিরে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বিরোধ দানা বাঁধতে শুরু করেছে।
আটই জুন, ১৯৮১ দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে তাদের প্রতিবেদক উইলিয়াম বর্ডার্স এক রিপোর্টে লেখেন, দক্ষিণ তালপট্টিতে ভারতীয় নৌবাহিনীর দুটি রণতরী ভিড়েছে এবং সেখানে ভারতীয় পতাকা পুঁতে একটি রেডিও স্টেশনও স্থাপন করা হয়েছে – বাংলাদেশ এটা আবিষ্কার করার পর দু`দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছিল।
জিয়াউর রহমানের জীবনের শেষ পর্বে এই দক্ষিণ তালপট্টিকে কেন্দ্র করে দিল্লির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠেছিল।
তবে তাঁর মৃত্যুর দিনদশেক পরে লেখা ওই রিপোর্টে আরও মন্তব্য করা হয়েছিল, “যদিও প্রেসিডেন্ট জিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খুব সহজ ছিল না – তারপরও তিনি নিহত পর বাংলাদেশের পরিবেশ অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে এই আশঙ্কা দিল্লিকে ঘিরে ধরেছে।”
বিবিসি