রুবায়েত ফয়সাল আল-মাসুম এর ছোটগল্প: মোল্লা বউয়ের হিল্লা বিয়ে
দ্বিতীয় পর্ব
অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অনভিপ্রেত ঘটনার মুখোমুখি হয়ে লেবুমোল্লা অনেকটা নিরব হয়ে গেছেন। এই রাগারাগির ঘটনা লেবুমোল্লার জীবনে নতুন করে কিছু না। প্রথম বউ সেতারা বেগমের সাথেও এমন রাগারাগি অনেকবার হয়েছিলো। কিন্তু সেতারা বেগম ভালো পরিবারের শান্ত প্রকৃতির মেয়ে। লেবুমোল্লার রাগের সাথে কখনও পাল্টা রাগ দেখায় নি। কর্তা রাগ করলে ঘরের বউয়ের নিরব থাকতে হয়। নিরব থাকার ফল এখন সেতারা বেগম ভোগ করছেন। বাড়ীর সকল মানুষ সেতারা বেগমকে একজন শান্তসিষ্ঠ ভালো মহিলা হিসেবে জানেন। একজন দুই জন করে গ্রামের প্রায় সকল লোক জেনে গেছেন, লেবুমোল্লা তার বউকে তালাক দিয়েছেন। লেবুমোল্লা এবং নাসিমা বেগম বাড়ির দুটি ভিন্ন ঘরে অবস্থান করেন, এখন আর গরমে লেবুমোল্লাকে কয়েল ধরতে কেউ আর নিষেধ করে না। আর নাসিমা বেগমকে মশারি খাটাতে কেউ নিষেধ করে না। দেখতে দেখতে তিনমাস অতিক্রম করলো। গ্রামের মানুষের এ বিষয় নিয়ে সমালোচনা দিন দিন বেড়েই চলছে।
এই সমালোচনা বন্ধ করতে চেয়ারম্যান সাহেব মেম্বার আর মাতব্বরদের কে নিয়ে সালিশ ডাকলেন। যথা সময়ে সকলে সালিশে উপস্থত হলেন। লেবুমোল্লা বললেন আমি তো আমার বউকে তালাক দিসি রাগ করে, তখন আমার মাথা ঠিক ছিলো না। এখন আমি আমার ভুল বুঝতে পারছি, এখন আমি আমার বউরে ঘরে তুলবার চাই । কিন্তু সালিশে উপস্থিত প্রায় সকলে লেবুমোল্লার বিরোধিতা করলেন। মেম্বার বললেন, রাগকরে আপনি তালাক কেনো দিলেন? গালি গালাজ করতে পারতেন, তালাক দিলে বউ যে ছাড়া হয়ে যাবে এটা তখন মাথায় ছিলো বলেই তো তালাক দিসেন। ইমাম সাব বললেন এখন এই বউ আপনার জন্য হারাম, ইসলামি শরিয়ত মতে এই বউকে আপনার বৈধ করতে হলে হিল্লা বিয়ে দিতে হবে, চেয়ারম্যান সাহেব ইমাম সাহেবের পরামর্শে বললেন এ অবস্থায় লেবুমোল্লা আপনার বউকে হিল্লাবিয়ে দেয়া ছাড়া কোনো উপাই নাই। উপস্থিত মানুষের মধ্যে দুই জন হিল্লে বিয়ে করার জন্য রাজিও হলো। কিন্তু লেবুমোল্লা জানেন হিল্লা বিয়ে দেবার পর যদি স্বামী তালাক না দেয় তবে তার কিছুই করার থাকবে না। তাই কার সাথে হিল্লা বিয়ে দিবেন তা পরবর্তীতে ইমাম সাব আর চেয়ারম্যান সাবকে জানিয়ে দেয়া হবে। এই বলে সেদিনের মতো সালিশ মুলতবি করা হয়।
অল্প বয়সী নাসিমা বেগম সমাজের দেন দরবারের মাথা মুন্ডু কিছুই বুজে উঠতে পারে না। তাকে আবারও অন্য কোথাও বিয়ে বসতে হবে আবার সেই স্বামী তাকে তালাক দিবে পরে আবার লেবুমোল্লা তাকে বিয়ে করবে। একথা ভাবতেই নাসিমা বেগমের মাথা নষ্ট হয়ে যায়। তাই সে প্রতিদিন বাপের বাড়ি চলে যেতে চায়। কিন্তু লেবুমোল্লার নিষেধাজ্ঞা আছে শুনে নাসিমা বেগম যেতে পারে না।
সমাজের মানুষের সিদ্ধান্তের আলোকে লেবুমোল্লা শেষ বয়সে এসে মহা চিন্তায় পরে গেলেন। এখন হিল্লা বিয়ের জন্য কোথায় মানুষ খুজতে যাবেন। বিয়ে করার মানুষ পাওয়া যাবে কিন্তু বিয়ে করে পরে যদি তালাক না দেন তবে তো হবে আরেক যন্ত্রণা। তাই লেবুমোল্লা তার প্রথম স্ত্রী সেতারা বেগমের সাথে পরামর্শ করতে বসলেন। ঠান্ডা মাথার মহিলা সেতারা বেগম শুরু থেকে এ পর্যন্ত লেবুমোল্লার পাশে আছেন। তাই লেবুমোল্লার মনে একটা বিশ্বাস আছে সেতারা বেগম নিশ্চয়ই একটা সমাধান ঠিক বের করে দিতে পারবেন।
তাই সেদিন সকাল নাস্তার পর সেতারা বেগমকে ডেকে পাঠালেন। নাসিমা বেগম তো নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়ে সারাদিন কান্নাকাটি করে চোখ ফুলাইয়া ফেলছে কি করা যায় সেতা? পান চিবাতে চিবাতে লেবুমোল্লা জিজ্ঞেস করলেন। ছোটর এই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য কাছের কারও কাছে বিয়ে দিয়ে বিষয় টা সহজ করা যায় না। তুমি কার কথা বলতেছো সেতেরা বেগম? আসলে আমি বলছিলাম আপনার বড় নাতি তুহিনের কথা, তার সাথে বিবাহ দিয়ে পরে না হয় পরদিন তালাক দিয়ে দিবে। সেতারা বেগম তুমি তো ভালো কথা বলেছো। তুহিনের মা কি এই বিয়েতে রাজি হবে? তা হবে কিনা জানি না, এটা তো আসলে বিয়ে না, তবে আপনি যদি বলেন আমি বউমার সাথে কথা বলে দেখতে পারি। সেতা তুমি ঠিক বলেছো, তবে নাসিমাকে বিয়ে করে আবার তালাক দেয়ার জন্য যদি তুহিনকে এক বিঘা সম্পত্তিও লিখে দিতে হয় তবুও আমি রাজি আছি। আমার হয়ে তুমি তুহিন আর তার মায়ের সাথে কথা বলো।
সময় সুযোগ করে সেতারা বেগম তার বড় পুত্রবধু আর নাতি তুহিন কে এই বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু তুহিনের মা এই বিয়ে কোনভাবেই মানতে রাজি হলো না। আমার একমাত্র ছেলে, তাকে এই বিয়ে করালে তার ভবিষ্যৎ বলে কি কিছু থাকবে? তুহিন বড় হলে তাকে আর আমি বিয়ে করাতে পারবো না। সেতারা বেগম অনেক বুঝিয়ে বললেন অন্য কেউ বিয়ে করলে পরে যদি তালাক না দেয় তবে তো আমাদরর বাড়ির বউ আর পাবো না। রেগে গিয়ে বউ বললেন বুড়া বয়সে ভীমরতিতে ধরছে, বিয়ে করা লাগে। অনেকবার আমরা না করছি বিয়ে করবেন না, আমাদের কথা কি সেদিন শুনেছিলো? সেদিন শুনলে আজকে এই দিনটা দেখা লাগতো না। সেতারা বেগম বললে সেসব কথা বাদ দাও, তোমার জামাই জমি কি কিছু রাখছে? সব তো বিক্রি করে উজার করে দিসে, এখন ছেলের জন্য তো কিছুই নাই। বলি কি তোমার শ্বশুরকে বলে এক বিঘা সম্পত্তি তোমার ছেলের নামে লিখে দেওয়ার ব্যবস্থা করি। তাছাড়া বড় হয়ে গেলে এসব আর কেউ মনে রাখে না। তুহিন তো আর মেয়ে না, যে তাকে বিয়ে দিতে হবে। দাদা যদি বুড়া বয়সে সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করতে পারে তুহিনও পারবে বিয়ে করতে। বউ মা তুমি আর অমত করো না। বউ চিন্তা করে দেখলেন কথা তো ঠিক, তার স্বামী কোন কাজ না করে জমি সব বিক্রি করে টইটই করে ঘুরে বেড়ায়। এখন যদি এক বিঘা সম্পত্তি ছেলের নামে পায় তবে মন্দ হয় না। তাই স্বামীর সাথে পরামর্শ করে রাজি হয়ে গেলেন।
চলবে…….
লেখক:
প্রকৌশলী রুবায়েত ফয়সাল আল-মাসুম
সহকারী প্রকৌশলী
বিএডিসি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ক্ষুদ্রসেচ জোন,
ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
ই-মেইল: [email protected]