...
Friday, February 14, 2025

ছোটগল্প: বেঈমান

চাকুরির খবর

রুবায়েত ফয়সাল আল-মাসুম এর ছোটগল্প: বেঈমান

এক

একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে সদ্য এমবিবিএস পাশ করেছি। শিক্ষানবিশকাল সমাপ্ত করে জেলা শহরের এক স্বনামধন্য মেডিকেল সেন্টারে পার্টটাইম জব করে জনগনের সেবা দিয়ে যাচ্ছি। প্রতিদিন আট ঘন্টা ডিউটি থকে । কখনও দিনে আবার কখনও রাতে ডিউটি পরে। ডাক্তারি জীবন বড় অদ্ভুত রকমের। নিজের সময় বলতে কিছু থাকে না, ২৪ ঘন্টা ডিউটি থাকে, মানুষ অসুস্থ হলেই ডাক্তারকে ফোন দেয় । তবে মাঝে মধ্যে বিরক্ত হলেও আমার কাছে ভালোই লাগে। কারণ জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আল্লাহ তায়ালার সাহায্যের ওসিল্লা হয় এই ডাক্তার। প্রতিদিন কত আজব এবং অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকি তার কোন হিসেব নেই। আমার সাথে তেমনি একটা ঘটনা ঘটে কিছুদিন আগে। হঠাৎ সেদিন মেডিকেল সেন্টারে আমার ডিউটি পরে রাতের বেলা। রাত দশটার দিকে হাসপাতালে একজন মহিলা রোগী আসে ডেলিভারি কেইস নিয়ে। তাৎক্ষনিক পেসেন্টের কয়েকটা টেস্ট করি। রিপোর্ট দেখে বুঝতে পারলাম বাচ্ছার অবস্থান ভালো না, নরমাল ডেলিভারিতে হবে না অপারেশন করতে হবে।

রোগীর সাথে এসেছেন রোগীর ছোট বোন আর মা। রোগীর সাথের লোকদেরকে জানালাম আপনাদের রোগীকে এক্ষুনি অপারেশন করতে হবে। অপারেশনের কথা শুনতেই রোগীর মা মোটামুটি উত্তেজিত হয়ে গেলেন। বললেন আমার মেয়ের ডেলিভারি এমনিতেই হবে, আমরা অপারেশন করাবো না। পুরনো দিনের মহিলা। পুরুষ ডাক্তার দিয়ে আমরা অপারেশন করাবো না, সাফ সাফ জানিয়ে দিলেন। তবে এ ধরনের ভাবনা থাকাটা অসাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু হাসপাতালে এই মুহূর্তে মাহিলা ডাক্তার নেই, আর এই মুহূর্তে অপারেশন না করালে রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। নার্স বিষয়টা তাদের অবগত করলে আর কোন উপায়ন্তু না দেখে ভদ্রমহিলা পুরুষ দিয়ে অপারেশন করাতে রাজি হলেন। সুষ্টুভাবে অপরাশন হলো, অপারেশন শেষে ফুটফুটে একটি ছেলের জন্ম হয়। নিজেকে ভালো লাগছে বেবির মায়ের মুখের হাসি দেখে, সত্যি অকৃত্রিম। ভালোকাজ করলে সত্যি মনটা ভালো হয়ে যায়। পরে অবশ্য জানতে পেরেছি যার সার্জারী করেছি সেই মহিলার স্বামী আমার এলাকার সম্মানিত একজন বড়ভাই। ডাক্তারদের জীবনটাই এমন অনেক ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়, রোগী কে বাঁচিয়ে তুলা আমাদের সবচেয়ে বড় কাজ। রোগী কে বা কার আত্মীয় এটা দেখার কোনো অবকাশ নেই। তবুও দেশে আমাদের বদনামের শেষ নেই। অল্প কিছুক্ষণ বেবীর বাবা মানে রোগীর হাসবেন্ড আসলেন। উনার সাথে পরিচয় হলো, আমাকে বড়ভাই অনেক ছোটবেলায় দেখেছিলেন। ভাইকে দেখে অনেক হাসিখুশি মনে হলো। জীবনের প্রথম পুত্র সন্তানের বাবা হযেছেন। তাৎক্ষণিক মেডিকেল সেন্টারে উপস্থিত সবাইকে মিষ্টিমুখ করালেন। উনার রোগী এখন পোস্ট অপারেটিভ থিয়েটারে আছে, আর বেবিকে শিশু ওয়ার্ডে পাঠিয়ে আমি চেম্বারে বসে আছি। এই অবস্থায় রোগীর সাথে অন্য কোন পুরুষ মানুষ সাথে না থাকায় ভাইকে সারারাত হাসপাতালেই থাকতে হবে। তাই আমার চেম্বারে বসে আছেন, আমরা গল্প করছি, আমারও বোরিংনেসটা কেটে যাচ্ছে।

ভাইয়ের নাম অরণ্য, বহুদিন আগে দেখা হয়েছিলো বলতে গেলে একেবারে ছোট বেলায়। অরণ্য ভাই গনিতে খুব মেধাবী একজন ছাত্র ছিলেন। ছাত্রজীবনে দারিদ্র্যতার কষাঘাতে ভালো কোন প্রতিষ্ঠানে পড়তে পারে নি, শুনেছি স্থানীয় পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা করে একটা বেসরকারি জব করছেন। ভাই গণিতে মেধাবি হওয়ার কারণে এলাকতে প্রচুর টিউশনি করাতেন। পরে অবশ্য একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করেছেন। কিন্তু পারিবারিক এক সমস্যার কারণে বিয়েটা করতে একটু দেড়ি হয়েছে। এছাড়া ভাইয়ের ব্যপারে আমার আর কিছুই জানা হয়ে উঠে নি।

ভাই তখন আমার সামনে বসে আছে এমন সময় নার্স এসে বলছে স্যার ২০৩ নাম্বার বেডে যে রোগীর কিডনি ডায়ালাইসিস চলছে তার অবস্থা ভালো না, প্রেশার খুব লো হয়ে গেছে, এক্ষুনি রক্ত লাগবে। কিন্তু রোগীর পাশে তার বৃদ্ধবাবা ছাড়া আর কেউ নাই। উনার মিসেস রক্তের জন্য বাহিরে গেছেন কিন্তু এখনও আসেন নি। হাসপাতালের ব্লাডব্যাংকে এই গ্রুপের কোনো রক্ত নেই। তবে আধাঘন্টার ভিতরে রক্ত না পেলে সমস্যা হবে। আমি কথাগুলো শুনে খুব ব্যস্ত হয়ে পরলাম, আমার কাছে সব রোগী সমান। আমার রক্ত এ পজেটিভ, রোগীর রক্তের গ্রুপ ও পজিটিভ, যদিও এই রক্ত খুব এভেইলেবেল তবে প্রয়োজনের সময় না পেলে সব রক্ত রেয়ার।

নার্সের মুখে কথা শুনতে শুনতে অরণ্য ভাই বলতে লাগলেন ছোটভাই আমার রক্তের গ্রুপ ও পজিটিভ। তোমার আপত্তি না থাকলে আমি রক্ত দিতে পারবো। এত কাছে রক্ত পেয়ে আমার নিজের কাছে প্রশান্তি লাগছে। ক্রস ম্যাচিং আর কযেকটি টেস্ট করে দেখলাম সবকিছুই ঠিক আছে। তাই পেশেন্টের জন্য ভাইয়ের রক্ত নিচ্ছি, রক্ত নেয়ার শেষ মুহুর্তে পেশেন্টের মিসেস শূণ্য হাতে হাসপাতালে আসলেন। অনেক ঘুরাঘুরির পর কোথাও নাকি কোন রক্তের ব্যবস্থা হয় নি। এমনিতেই কয়েক রাত না ঘুমিয়ে অনু ফ্যাকাসে হয়ে গেছে তার উপর আবার রক্ত না পেয়ে দুচোখ আরও অন্ধকার হয়ে গেছে। মেয়েটির নাম অনু, চোখে মুখে যেনো হতাশা আর ক্লান্তির ছাপ। অসুস্থ স্বামী কে বাঁচাতে পারবে কিনা তার মনে শংকা কাজ করছে। নার্স যখন জানালো রক্ত পাওয়া গেছে, তখন অনুর মুখে দেখলাম হাসিতে পূর্ণিমা চাঁদের হাসি ফুটে উঠলো।

বিপদের সময় রক্ত পেলে সকলের মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠে। অনুর স্বামীর দেহে রক্ত পাস হচ্ছে আর প্রেশার সাভাবিক দেখে অনু রক্তদাতাকে কৃতজ্ঞতার জন্য খুঁজতে লাগলেন। অরণ্য ভাইয়ের সাথে আমার গল্পের মুহূর্তে অনু এসে উপস্থিত হয়েছেন। আমি অনুর সাথে অরণ্য ভাইয়ের পরিচয় করিয়ে দিলাম। অনু বিনয়ের সাথে অরণ্য ভাইকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন ধন্যবাদ দিচ্ছেন । যখন দুজন একে অপরে মুখোমুখি হলেন দুজনেই আশ্চর্য হয়ে গেলেন। অরণ্য ভাই আর অনু দুজনেই অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মুহূর্তের মাঝে অনুর দুচোখ থেকে অঝড় ধারায় জল ঝরছে। কি আশ্বর্য ব্যপার? এ দৃশ্য দেখে আমি অরণ্য ভাইকে ডাক দিলাম। এ অবস্থায় তাদের দুজনের নিরবতা ভাঙে।

দুই

কান্না ছাড়া অনু তখন আর কোন কথা বলে নি। দৌড় দিয়ে ওয়ার্ডে স্বামীর কাছে চলে যায়। এই সেই অনু যার জন্য অরণ্য ভাইয়ের জীবন থেকে দশ দশটি বছর চলে গেছে। হাতের ব্যস্ততা সেরে অরণ্য ভাই অনুকে নিয়ে তার জীবনের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা দিলেন।

১৯৯৬ সারের কথা আমি তখন ক্লাশ টেনে পড়ি। নিজের পড়াশুনার পাশাপাশি গ্রামে কোচিং আর টিউশনি করাতাম। একদিন কোচিং এ আমার গণিত ক্লাস অনুর খুব পছন্দ হয়। অনু তার বাবাকে দিয়ে আমার কাছে বাসায় একা পড়ার প্রস্তাব দেয়। হাতে সময় থাকায় আমিও রাজি হয়ে যাই। একে তো টাকার অফার ভালো ছিলো সেইসাথে অনুও ছাত্রী হিসেবে খারাপ ছিলো না। পড়ার শুরুর দিন থেকে অনু বদ্র বারিকার মতো আমার সামনে পড়তে বসতো।আমার কাছে পড়াশোনার সাথে সাথে অনুর ক্লাশের ফলাফল দিন দিন আগের চেয়ে ভালো হতে লাগলো। আগে এক বিষয় পড়াতাম পরে গনিত বিজ্ঞান ও অন্যান্য বিষয় পড়াতে লাগলাম।

এই পড়ানোর সূত্র ধরে অনুদের বাসায় দীর্ঘসময় থাকা হতো, খাওয়া দাওয়া হতো। অনুদের পরিবারের সবাই আমাকে অনেক আদর করতো। এই পড়াতে পড়াতে কখন যেনো আমি অনুর হৃদয়ের সর্বোচ্চ আসন দখল করে নিয়েছিলাম তা টের পাই নি। অনু দেখতে এতো সুন্দরী না হলেও প্রতিদিন তাকে দেখতে দেখতে আমিও অনুর প্রতি কেমন জানি দুর্বল হয়ে গেলাম। বইয়ের ভিতর লাভ চকলেট রাখা খাতায় I love you লিখে রাখা, প্রতিদিন এমন অনেক সিচুয়েশনের মুখোমুখি হতে হতে আমিও অনুকে আমার মনে স্থান দিতে লাগলাম। কিন্তু এটা শহর না এটা গ্রাম, আমাদের এমন মন দেয়া নেয়া সমাজের চোখে খুব ভালো দেখাবে না। তাছাড়া পরিবারে এ বিষয় প্রকাশ পেলে বিষয় টা যে দুই পরিবারের মান সম্মানে আঘাত হানবে, সেটাও মাথায় আসলো। তাছাড়া অনুর পরিবার সমাজে যথেষ্ট দাপুটে এবং অনেক বিত্তশালী ছিলো।

আমাদের এই আবেগীয় সম্পর্ক কতটুকুই মেনে নিবে তা নিয়ে শংকায় ছিলাম। দেখতে দেখতে আমার এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হলো। স্টার মার্কস নিয়ে উত্তীর্ণ হলাম। আমার ফলাফলে আমার পরিবার স্কুলের শিক্ষকসহ অন্যান্য সকলে খুব খুশি হলেন। ফলাফলের খুশিতে অনু আমাদের এই সম্পর্কটা তার পরিবারের সবাইকে জানিয়ে দেয়। অনুর বড়ভাই বিষয়টি নিয়ে অমত থাকলেও অন্যান্য সকলের সম্মতি থাকায় পরে আর না করে নি। এই মুহূর্তে আমি যদি দূরে কোন কলেজে ভর্তি হই তাহলে অনুকে পড়া দেখানোর লোক থাকবে না। এই চিন্তায় আমি জেলা শহরের একটা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ভর্তি হই। আর আমার পড়ার ফাকে অনুকে তার পড়া দেখিয়ে দিই।

আমাদের এই প্রেম ভালোবাসার কথা ধীরে ধীরে সমাজের প্রায় সকলের মাঝে প্রকাশিত হয়ে যায়। তবে আমার সম্পর্কে মানুষের একটা ভালো ধারনা থাকায় এবং অনুদের পরিবার সমাজে যথেষ্ট বিত্তশালী হওয়ায় এ বিষয়টি নিয়ে কেউ কোনোদিন উচ্চবাচ্য করে নি। আমার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে পড়াশোনা শেষ হয়ে গেছে, ততদিনে অনু এসএসসি পাশ করে। এমন সময় একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে আমার ভালো বেতনের একটা চাকরির অফার আসে। যদিও আমার ইচ্ছে ছিলো ডুয়েট থেকে বিএসসি’র জন্য একটা চান্স নিবো, কিন্তু পরিবারের অার্থিক সংকট থাকার কারণে আমি চাকরিতে যোগদান করি। বেসরকারি হলেও বেশ ভালো বেতন ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা ছিলো।

প্রথম দিকে ডুয়েটে বিএসসির ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার ইচ্ছে থাকলেও পরে চাকরির নেশায় তা আর হয়ে উঠে নি। যে টাকা পেতাম তা দিয়ে আমার পরিবারের খরচ মিটিয়ে অনুকেও দিতে পারতাম। সময়ের সাথে সাথে আমাদের সম্পর্কের অনেক আপস এন্ড ডাউন থাকলেও ভালোবাসা যেনো ঠিক আগের মতোই ছিলো। যদিও আমার শ্বশুর বাড়ি তখনও হয় নি তবুও যতবার বাড়িতে আসতাম অনুদের বাড়িতে ঠিক জামাই আদর পেতাম। প্রতিষ্ঠানে আমার প্রমোশন হয়, বেতন আগের চেয়ে বেশী হয়। অনুর নামে একাউন্ট খুলে আমার কিছু টাকা অনুর একাউন্টে রাখতাম ভবিষ্যতের কথা ভেবে। বিবাহিত সম্পর্ক ছাড়াই অনুরও আমাদের বাড়িতে নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিলো।

অরণ্য ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম বিয়ে ছাড়া একটা সম্পর্ক এতদিন কিভাবে ঠিক ছিলো? অরণ্য ভাই বরলেন আসলে বিষয় টা ছিলো পারষ্পরিক বিশ্বাস। আমরা একে অপরের প্রতি অনেক বিশ্বাস করতাম। এতদিন এতো কাছাকাছি থাকার পরও আমি কখনও অনুর হাতটিও ধরতে চেষ্টা করিনি।

অরণ্য ভাইয়ের গল্প শুনতে শুনতে রাত তখন প্রায় বারোটা বাজে। রাতের খাবার খাওয়া হয় নি। অরণ্য ভাই আমাকে বাহিরে কোথাও ডিনারের অফার দিলেন। কিন্তু আমি বাহিরের খাবার খাই না। বাসা থেকে রাতের খাবার নিয়ে আসি। তাছাড়া বাহিরের হোটেলে ভালো খাবার পাওয়া যাবে না। আমার টিফিনকারীতে যে খাবার আছে তাতে দু জনার হয়ে যাবে। তাই এই খাবার দু জনে খেয়ে নিলাম। পরে চা খেতে খেতে খেতে অরণ্য ভাইয়ের বাকি গল্প শুনতে লাগলাম।

জীবনে অনুকে এতটা ভালোবেসেছি যে আমার উপার্জনের টাকা দিয়ে প্রথম যে জমিটা কিনি সেটা আমি অনুর নামেই রেজিস্ট্রি করি। অনু তখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী তখন পরিবারে আমাদের বিয়ের একটা কথা উঠে। কিন্তু আমাদের দুই পরিবার চায় অনুর পড়াটা শেষ হোক তারপর বিয়ে। আমরাও পরিবারের সিদ্ধান্ত কে সম্মান জানাই।

তিন

২০০৮ সালের কথা অনুর তখন ফাইনাল ইয়ারের রিজাল্ট বের হয়েছে, আর সেই সময়ে প্রাইমারিতে শিক্ষক নিয়োগের একটা সার্কুলার হয়। অনুর খুব ইচ্ছে ছিলো সে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের টিচার হবে। অনুর প্রতি আমার ভালোবাসা এমন ছিলো যে, আমার সাধ্যের ভিতর অনুর কোন ইচ্ছে যেনো অপূর্ণ না থাকে। তাই আমার পরিচিত লোক ধরে চার লক্ষ টাকা উৎকোচ দিয়ে অনুর শিক্ষকতার চাকুরির স্বাদ পূর্ণ করলাম।

আমিও তখন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি ডিগ্রি শেষ করেছি। আমার নেক্সট প্রমোশন হলো। আমার অফিসের ভিষণ ব্যস্ততা থাকায় অনুর সাথে যোগাযোগ আগের চেয়ে অনেকটা কমে গেলো। আমাদের দুজনের পরিবার আমাদের বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন। যেহেতু আমি সবসময় পরিবারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলাম, এভাবে আর কতদিন? আমিও সংসারি হওয়ার বিষয়ে মত দিলাম।

কিন্তু কিছদিন ধরে অনু আমার সাথে ফোনে বেশি কথা হয় না। প্রথমে আমি অনুর স্কুলের ব্যস্ততার কথা ভেবে বিষয় টা সাভাবিক ভাবেই নিয়েছি। তখন মাঝে মধ্যে অনুকে মোবাইলে দীর্ঘ সময় ধরে বিজি পাই। এলাকা থেকে আমার এক শিক্ষক বন্ধুর ফোন আসে, সে জানায় দোস্ত তুমি দ্রুত বিযে করো, পাখি উড়াল দিতে পারে। অনুকে নাকি প্রায়ই তার কলিগের সাথে এক রিক্সায় করে বিভিন্ন জায়গায় যেতে দেখা যায়। নতুন যোগদানকৃত প্রধান শিক্ষক, অফিসের কাজে এমনটা হতে পারে । অনুকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করবো কিনা ভেবে পাই না।

এদিকে আমার অফিস আমাকে এক বছরের জন্য ইংল্যান্ডে এক বছরের একটি প্রশিক্ষণ কোর্সের জন্য মনোনিত করেছে। তখন আমার পাসপোর্ট রেডি করা এবং ভিসার জন্য এমবাসিতে দৌড়াদৌড়ি করতে সময় যাচ্ছে। তবুও অনুর ব্যাপারে আমার মনে কোন বাজে চিন্তা আসে না। আমার দেশের বাহিরে যাওয়ার বিষয়টা আমি অনুকে বলি নি। তাই চিন্তা করলাম বাহিরে যাওয়ার আগে বিয়েটা করে ফেলি। বাসর রাতে এই সংবাদ হবে অামার পক্ষ থেকে অনুর জন্য সবচেযে বড় সারপ্রাইজ।

আমার হাতে সময় খুব কম। এজন্য বসকে বলে এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে বাড়ি আসি বিয়ে করার উদ্দেশ্যে। আমি রাস্তায় মনে মনে বিয়ের বাজার সওদা, বিভিন্ন মানুষকে দাওয়াত দেয়া আরও কতকিছু নিয়ে চিন্তা করছি। ঠিক সে সময় আমার মোবাইলে ছোট বোনের ফোন আসে। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ টা অপেক্ষা করছে তা কখনও বুজতে পারিনি। বোন জানায় আজ সকালবেলা আমার আসার কথা শুনে অনু তার স্কুলের প্রধান শিক্ষক কে কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে। সংবাদটা আমার কাছে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো মনে হলো। তাহলে কি বন্ধুর কথায় সত্য হলো?

এত দিনের শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, ভালোবাসার সম্পর্কের কি কোন মূল্য ছিলো না অনুর কাছে? নিজের মনের মাঝে অনেক প্রশ্নের উদয় হতে লাগলো। বিষয়টা আমি কিভাবে নিবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কোন স্বার্থে অনু এমন বেঈমানী আর সর্বনাশা সিদ্ধান্ত নিলো তা আমার জানা নাই। নিজের মাঝে আক্রোশ, রাগ আর ঘৃণাকে সংবরণ করতে লাগলাম। তখন আমি আর অনুকে ফোন দিলাম না। এ সময় গ্রামের মানুষের মুখোমুখি হলে আমি হাসি আর করুনার পাত্র হবো এই ভেবে রাস্তায় থেমে দেড়ি করে রাতে বাড়ি গেলাম। রাতে রাতেই বাবা মায়ের সাথে দেখা করে সাভাবিকভাবে সেই রাতেই ঢাকা চলে আসি।

কারণ আমার জানা ছিলো এ অবস্থায় আমার উত্তেজিত হওয়া চলবে না, মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। আমি আমার জীবন জীবিকার প্রয়োজনে দারিদ্রতার কষাঘাতে অনেকটা রোবটের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। প্রচুর কষ্ট পেয়েছি কিন্তু প্রকাশটা ছিলো না, সহ্য করেছি, ধৈর্য্য ধরেছি। কোম্পানীকে বলে একমাস পরের ফ্লাইট অনেক রিকুয়েষ্ট করে একমাস আগে নিয়ে আসলাম।

অরণ্য ভাইয়ের গল্প শুনে শুনে রাত দুইটা বাজে। আমার চোখে এক মুহূর্তের জন্য ঘুম আসেনি। মানুষ কিভাবে এমন হয়? আমার বুজে আসছে না। অরণ্য ভাই আবার শুরু করলেন।

তবে একবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম জীবনে বিয়ে টা আর করবো না। এক বছরের জন্য ইউকেতে গিয়ে সৌভাগ্যক্রমে তিন বছর ছিলাম। কাজের ব্যস্ততায় অতীত স্মৃতি অনেকটা ভুলে থাকতে পেরেছি। মানুষ মরে গেলে সান্ত্বনা পাওয়া যায কিন্তু বেঁচে থাকা মানুষ এমন বেঈমানী করলে তাকে ভুলা যায় না। দেড় বছর হলো দেশে এসেছি। মা-বাবা আর ভাইবোনের অনুরোধে বিয়ে করি। বাড়ি গাড়ী সব হযেছে তবুও হৃদয়ে যে একটা ক্ষত হযেছে তা আজও শুকায় নি, ভাবলে চোখে জল আসে। আমার কি অপরাধ ছিলো? সে প্রশ্নের উত্তর আমি খুঁজে পাই নি।

ফজরের আজান হচ্ছে, অরণ্য ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম “আচ্ছা আপনি কি অনুকে ক্ষমা করতে পেরেছেন?” অরণ্য ভাইয়ের একটাই উত্তর ছিলো “আমি সবকিছুই মহান আল্লাহর রাব্বুল আলামিনের কাছে সমর্পন করেছি ” উনি আমার জীবনে অনেক কিছুই দিয়েছেন। উনার সকল ফায়সালা সকলের জন্য মঙ্গলকর।

সকালবেলা আমার ডিউটি শেষ হওয়ায় বাসায় চলে এসেছি। পরদিন নার্সের কাছে শুনতে পাই, সেদিন রাতে অনু লুকিয়ে আমাদের রাতের কনভারসেশন শুনেছিলো আর ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদেছিলো। কয়েকদিন আমার অসুস্থতা থাকায় ডিউটিতে যেতে পারিনি। পরে একদিন আমার কলিগ ডাক্তারের কাছে শুনতে পাই অনুর স্বামীর অবস্থা খুব আশংকাজনক। স্পেশালিষ্ট ডাক্তার তাদের বিদায় দিয়েছেন।

লেখক:
প্রকৌশলী রুবায়েত ফয়সাল আল-মাসুম
সহকারী প্রকৌশলী
বিএডিসি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ক্ষুদ্রসেচ জোন,
ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
ই-মেইল: [email protected]


- Advertisement -

আরও সাম্প্রতিক খবর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -

সর্বশেষ খবর

Seraphinite AcceleratorOptimized by Seraphinite Accelerator
Turns on site high speed to be attractive for people and search engines.