গত বছরের মার্চ মাস থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন। আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া ভিক্টিমদের ৪৯ শতাংশ ২০ থেকে ৩৫ বছর বয়সী, এদের মধ্যে ৫৭ শতাংশই নারী।
এক নজরে
- কোভিডের মাঝে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৫০ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা
- ২০০৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত আত্মহত্যা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩১ শিক্ষার্থী
- মহামারি নিয়ন্ত্রণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হওয়ার পর এখন পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছে ১১ শিক্ষার্থী
- শিক্ষার্থী ও তরুণদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা বৃদ্ধি
- নেই পর্যাপ্ত সংখ্যক মনোবিদ ও মনোচিকিৎসক
ঈদ-ঊল-ফিতরের একদিন পর ১৫ মে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পৈতৃক নিবাস থেকে রাজধানীতে ফিরেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমান।
ঘটনার দিন, হাফিজ শেষবারের মতো পরিবারের কাছে ফোন করে নিরাপদে ঢাকায় এসে পৌঁছানোর কথা জানায়। তার কন্ঠে অস্বাভাবিক কিছুর আভাস পায়নি পরিবার। কয়েক ঘন্টা পর পুনরায় হাফিজকে ফোন করা হলে পরিবারের সদস্যরা তার ফোন বন্ধ অবস্থায় পায়।
খোঁজ না পেয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়। কয়েকদিন ধরে অনুসন্ধানের পর ২৩ মে তরুণ এই শিক্ষার্থীর ভাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে তার লাশ শনাক্ত করেন।
হতাশাগ্রস্ত হাফিজ এলএসডি নামে পরিচিত লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইথ্যালামাইড গ্রহণের পর নিজেকে আঘাত করার মাধ্যমে মৃত্যুবরণ করেন। সূত্রানুসারে, কোভিড-১৯ মহামারিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এখন পর্যন্ত সরকারি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৫০ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, ২০০৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ৩১ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে। কিন্তু, কোভিড নিয়ন্ত্রণে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ১১ শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। বাস্তবিক বিবেচনায়, হাফিজের আত্মহত্যা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা ছিল না।
মর্মান্তিক এই ঘটনা কেন ঘটলো সেই প্রশ্নের উত্তর জানা যায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তদন্ত ও হাফিজের ঘনিষ্ঠদের দেওয়া তথ্য থেকে। দীর্ঘকালীন হতাশা থেকে হাফিজ এলএসডির মতো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হ্যালোসিনেশন সৃষ্টিকারী মাদক গ্রহণ করে।
হাফিজের ঘনিষ্ঠ সহচর মীর লোকমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানায়, “পরিবারের আর্থিক অবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকায় হাফিজ চরম হতাশায় ভুগছিলো। সে নিজের সমস্যাগুলো নিজের কাছেই রাখতো। কয়েকজন ব্যতীত কারও সাথেই এসব বিষয়ে আলোচনা করত না।”
“মহামারির মাঝে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তার হতাশা বৃদ্ধি পায়। হাফিজ পথ হারিয়ে ফেলেছিল, আর সেখানে তাকে সাহায্য করার মতো কেউ ছিল না,” বলেন তিনি।
বাড়ছে হতাশা, নেই কাউন্সেলিংয়ের পর্যাপ্ত সুযোগ
মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা এবং সমাজবিজ্ঞানীরা শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা বৃদ্ধির প্রবণতার কথা বললেও, তাদের যথাযথ কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা নেই। ফলে, প্রতিক্রিয়াস্বরূপ শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও বাড়ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, “তরুণদের আত্মহত্যার দিকে ধাবিত করার পেছনে প্রকৃত সমস্যাগুলো সুনির্দিষ্ট করে চিহ্নিত করতে পারার মতো কোনো মানসম্পন্ন গবেষণা নেই। আর তাই, নির্দিষ্ট করে কোনো কারণ বলা কঠিন।”
“তবে, আমরা ধারণা করতে পারি যে, হতাশা এবং যথাযথ কাউন্সেলিংয়ের অভাবে এই শিক্ষার্থীরা অবৈধ কাজে জড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি নিজেদের জীবন শেষ করে ফেলতে প্রবৃত্ত হয়,” বলেন তিনি।
অধ্যাপক নেহাল করিম আরও বলেন, “কোভিড-১৯ মহামারি চলাকালে দেশের অধিকাংশ মানুষের আয় হঠাৎ করেই সংকোচিত হয়েছে। অনেক শিক্ষার্থীরাই নিম্ন আয়ের পরিবার থেকে এসে থাকে এবং তারা সার্বিক পরিস্থিতির কারণে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।”
“এমনকি, ধনী পরিবার থেকে আসা শিক্ষার্থীরাও পর্যাপ্ত কাউন্সেলিংয়ের অনুপস্থিতিতে ভুল পথে পরিচালিত হয়,” বলেন তিনি।
দীর্ঘদিন ধর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং হলগুলো বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা বন্ধু বান্ধব এবং সহপাঠীদের দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বলে উল্লেখ করেন বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. মেহতাব খানম।
“মহামারির কারণে উপার্জন হারিয়ে বহু পরিবারে দারিদ্র্যতা বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। এ ধরনের সমস্যাগুলো শিক্ষার্থীদের জীবনে সরাসরি প্রভাব ফেলছে, ফলে অনেকেই হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে,” দ্য বিজন্সে স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন তিনি।
মানসিক সমস্যায় ভুগতে থাকা শিক্ষার্থীদের জন্য মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসাকে অত্যাবশ্যকীয় উল্লেখ করে অধ্যাপক খানম বলেন, “কিন্তু, দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বাংলাদেশে পর্যাপ্ত সংখ্যক মনোবিদ এবং মনোচিকিৎসক নেই। দেশে প্রায় ৩০০ মনোচিকিৎসক এবং ৫০০ জনের কম মনোবিদ রয়েছেন।
“তাদের মধ্যে, অনেকেরই প্রয়োজনীয় জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা নেই। সরকারের অবশ্যই পাঠাদানের ক্ষতিপূরণ এবং মানসিক সমস্যায় জর্জরিত শিক্ষার্থীদের সহায়তার উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। অন্যথায়, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সম্ভাবনা হারাতে বসবে,” বলেন তিনি।
সরকারকে নতুন মনোবিদদের কয়েকটি সেশনে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার পরামর্শ দেন তিনি। পরবর্তীতে, তাদের দেশজুড়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত করা সম্ভব হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাড়ছে আত্মহত্যা প্রবণতা
মহামারি-পূর্ব সময়ের তুলনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে উল্লেখ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রব্বানি। আত্মহনন কেন বাড়ছে তার কারণ অনুসন্ধানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
গত বছর প্রকাশিত, “সাইকোলজিকাল রেসপন্সেস ডিউরিং দ্য কোভিড-১৯ আউটব্রেক এমং ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস ইন বাংলাদেশ”- শীর্ষক একটি গবেষণায় দেখা যায় যে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের ৭৬ শতাংশই হতাশায় ভুগছে। এছাড়া, ৭১ শতাংশ শিক্ষার্থী উদ্বিগ্নতা এবং ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী মানসিক চাপের শিকার।
২০২০ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশবিদ্যালয়ের ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সী ৩১২২ জন শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণের ভিত্তিতে ইন্টারনেট-ভিত্তিক জরিপ পরিচালনা করেন গবেষকরা। যুক্তরাষ্ট্রের প্লস ওয়ান গবেষণা সাময়িকীতে প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়।
“স্ট্রেসরস অ্যান্ড মেন্টাল হেলথ ইন বাংলাদেশ: কারেন্ট সিচুয়েশন অ্যান্ড ফিউচার হোপস,” শীর্ষক অপর একটি প্রবন্ধে বাংলাদেশে চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত সংখ্যক মনোচিকিৎসক না থাকার কথা উল্লেখ করা হয়। গত বছর ১০ ডিসেম্বর ক্যামব্রিক ইউনিভার্সিটি প্রেসে প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়।
সাইকিয়াট্রিক রেসিডেন্সি গ্রহণে তরুণ মেডিকেল গ্র্যাজুয়েটদের প্রণোদনা প্রদানের পাশাপাশি প্রাথমিক সেবাদানকারীদের মানসিক উপসর্গ চিহ্নিতকরণ এবং সাধারণ সেবা প্রদানের জন্য দক্ষতার প্রয়োজন বলেও গবেষণায় উল্লেখ করা হয়।
আঁচল ফাউন্ডেশন পরিচালিত সর্বশেষ গবেষণার তথ্যানুযায়ী গত বছরের মার্চ মাস থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৪ হাজার ৪৩৬ জন আত্মহত্যা করে। অথচ, একই সময়ে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় আট হাজার ৪৬২ জন।
গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, কোভিড-পূর্ব একই সময়ে ১২ মাসে সংগঠিত আত্মহত্যার তুলনায় এই সংখ্যা ৪৫ শতাংশ বেশি। এছাড়া, করোনা ভাইরাস মহামারির সময় শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যা প্রবণতা আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়। বিষাদ এবং হতাশা বৃদ্ধি পাওয়ায়, বহু মানুষকে তা আত্মহত্যায় প্ররোচিত করছে।
বাংলাদেশে তত্ত্বাবধান, মানসিক চিকিৎসা এবং সহায়তা পাওয়া বেশ কঠিন। বিশেষত, তরুণদের জন্য। আর সে কারণেই বাড়ছে হতাশা। এছাড়া, গবেষণার তথ্যানুযায়ী, আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া ভিক্টিমদের ৪৯ শতাংশ ২০ থেকে ৩৫ বছর বয়সী, এদের মধ্যে ৫৭ শতাংশই নারী।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, প্রতি বছর বাংলাদেশে গড়ে আনুমানিক ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে।
এখন পর্যন্ত দেখা নেই কোনো সরকারি উদ্যোগের
শিক্ষামন্ত্রী দীপু মন্ত্রী একাধিক অধিবেশনে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যার সমাধানে প্রতি জেলায় অন্তত একজন মনোবিদ নিয়োগদানের পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করেন। এছাড়া, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ডিজিটাল পরিসরে এক লাখের বেশি শিক্ষককে প্রশিক্ষণ প্রদান করবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
কিন্তু, শিক্ষার্থীদের মানসিক সমস্যা দিনদিন বাড়তে থাকলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
এ বিষয়ে, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বলেন, “কোভিডের নতুন ঢেউয়ের কারণে নিয়োগদান প্রক্রিয়া থমকে আছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমরা মনোচিকিৎসক নিয়োগের মতো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।”