বিশ হাজার টাকায় কেনা একটি মাত্র ছাগল দিয়ে খামারী রাছেল ঢালী আজ কোটি টাকার মালিক। ১২ বছর ধরে তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন নিজের এ শখের খামার।
শখ পূরণ হয়ে এটি এখণ বাণিজ্যি পর্যায়ে এসে পৌঁচেছে। একটি থেকে শুরু হয়ে আজ তিনি ৭৫টি গরু-ছাগলের মালিক। রাছেল ডেইরী ফার্মটি লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার উত্তর চরবংশী গ্রামের সিআইপি বেড়িবাধের পাশে অবস্থিত।
রাছেল ঢালী জানান, তিনি ওই এলাকার ঢালী বাড়ির আব্দুল খালেক ঢালী ও পেয়ারা বেগম দম্পত্তির ২য় সন্তান। ছোট বেলা থেকেই তিনি ব্যাংকার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন।
ছাত্রজীবনে বাবার ইচ্ছার মূল্য দিতেই পড়েন মেডিকেলের প্যাথলজি বিভাগে। পাশ করে হয়ে যান ট্যাকনোলজিস্ট। চাকুরী করছেন ঢাকার একটি বেসরকারী প্যাথলজি সেন্টারে। সপ্তাহের ৫দিন ঢাকায় চাকুরী করে শুক্র ও শনিবার চলে আসেন বাড়িতে খামার পরিচর্যা করতে।
ডেইরী ফার্মটি চালুর বিষয়ে আলাপ হলে রাছেল ঢালী বলেন, বাবার কাছ থেকে ১০/২০ করে টাকা করে জমিয়ে ২০ হাজায় টাকায় একটি ছাগল কিনি। ওই ছাগল থেকে ৩টি বাচ্চা হয়। বাচ্ছা বিক্রি করি প্রায় এক লাখ টাকা। সেখান থেকে আরো কিছু জমানো দিয়ে ২ লাখ টাকা দিয়ে একটি শংকর জাতের গাভী ও দুটি ছাগল কেনা হয়। সেই থেকে গরু ও ছাগল পালনের যাত্রা শুরু। ১২ বছরে আগের শখ থেকে নেশা।
নেশাকে জয় করে বর্তমানে খামারের মূল্য কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। রয়েছে ৫০টি ছাগল ও ২৫টি গরু। খামারের নাম দিয়েছি ‘রাছেল ডেইরি ফার্ম। কিন্তু কোথাও কোনো সাইনবোর্ড এখনো লাগানো হয়নি। গরু পালন, দুধ বিক্রি, গোবর, বায়োগ্যাস প্লান্ট, কেঁচো দিয়ে জৈবসার প্রস্তুত করেই চলছে খামারের কার্যক্রম।
সরেজমিন ডেইরি ফার্মে দেখা যায়, প্রায় ৪০ শতাংশ জমির উপরে চাঁদপুর সেচ প্রকল্প বেড়িবাঁধের সাথে খামারটি গড়ে তোলা হয়েছে। মনোরোম পরিবেশে সারি সারি বাঁধা রয়েছে বকনা গরু ও ছাগল। প্রতিদিন ১০০ লিটার দুধ দেয় হয় এখানে। দুধের রয়েছে নির্দিষ্ট ক্রেতাও। গাভীর বাছুরগুলোকে যত্নে রাখা হয়েছে যেন কোনো রোগবালাই না হয়।
ফার্মে ১০ হাজার টাকা থেকে ৫ লাখ টাকা মূল্যের ছাগল দেখা গেছে। নিজ বাড়িতে তিনি দেশীয় জাতের ব্লাক ব্যাঙ্গল ছাগল, মোরগ-মুরগি, কবুতর পালনও শুরু করেছেন। আরো বড় পরিসরে খামার বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন রাছেল ।
গরু ও ছাগলের সফল খামারি রাছেল ঢালী বলেন, ইচ্ছে ছিল ব্যাংকার হবো। কিন্তু মেডিকেল লাইনে পড়তে গিয়ে স্বপ্ন ভঙ্গ হয়। এখন খামারের পরিধি অনেক বেড়েছে। খামারে গর্ভবতী গরুর সংখ্যাই বেশি। ১৫টি গাভী থেকে ১শ লিটার দুধ বিক্রি করা হয় ১৫ হাজার টাকা। খামারের বাছুরই হলো লাভের অংশ। বছর শেষে ৪০টি বাচ্চা হয় সাধারণত।
বাছুর থেকে আয় হয় প্রায় ২ লাখ ১০ হাজার টাকা। বর্তমানে সর্বসাকুল্য তার দেড় কোটি টাকার গরু ও ছাগল রয়েছে। খামারে বোয়ার, তোতাপুরি, হারিয়ানা, বিটল, শিরহি ও যমুনাপারি নামের জাতের ছাগল রয়েছে। আমার খামারে পিতা-মাতা, স্ত্রী ও ভাই সহযোগিতা করছেন। কাজ করছেন ৫ জন কর্মচারি।
২০১০ সালে ফিজিয়ান জাতের একটি গাভী থেকেই প্রজনন সম্প্রসারণ শুরু করি। বর্তমানে খামারে ২টি ষাঁড়, ১৫টি গাভি ও ১০টি বাছুর সহ ২৫টি গরু রয়েছে। এখানে একই জাতের গরু, অন্য কোনো জাত নেই। বর্তমানে দুধ দিচ্ছে ১৫টি গাভী।
আগ্রহী তরুণ গরু খামারিদের উদ্দ্যেশে রাছেল বলেন, গরু বা ছাগলের মালিকের ভবিষ্যৎ হলো বাছুর। যে মালিক বাছুরকে দুধ খাওয়ালো না, সে সম্পূর্ণই আয় থেকে বাদ পড়লো। যে বাছুরকে দুধ খেতে দিলো, গাভী মালিকের লাভ একটু যদি কমও হয় তবুও তার ইনভেস্ট হলো।
আর যদি কেউ আমার মত সফল খামারি হতে চায়, খামারের পরিসর বাড়াতে চায় অবশ্যই যে বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে, তা হলো- যদি দুটি করে গরু বাড়ে তাহলে দুটি করে গরুর থাকার ঘরের ব্যবস্থা করে ফেলতে হবে।
গরুর দুধের দাম কম, খাদ্যের দাম বেশি তাই খরচ কমাতে খাদ্যের জন্য একটু প্রযুক্তি নির্ভর হতেই হবে। কাঁচা ঘাসের কোনো বিকল্প নাই। খরচ সাশ্রয় হলে কৃষক লাভবান হবেন।।
রায়পুর শহরের বাসিন্দা কামরুল আল মামুন বলেন, রাছেল একজন সফল খামারি। মূলত: রায়পুর শহরের মানুষের কাছে মানসম্পন্ন খাঁটি দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্য পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্য নিয়েই ‘গোয়ালাস ডেইরিজ’ নাম দিয়ে রাছেলের কাছ থেকে দুধ নেয়া শুরু করি। বাজার মূল্যে এরকম খাঁটি দুধ পাওয়াতে ভোক্তাদের কাছেও এ দুধের জনপ্রিয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এ ছাড়াও আমাদের নিজস্ব কারখানায় এ দুধের তৈরী সর, দই এর ব্যাপক চাহিদা তৈরী হচ্ছে। আমি এবং আমার ব্যাংকার বন্ধুও এরকম একটি গরু ও ছাগলের খামার দেয়ার পরিকল্পনা করেছি। যাতে করে আরো বেশি মানুষের কাছে খাঁটি দুধ পৌঁছে দেয়া যায়।
রায়পুর উপজেলার চরবংশী ও চরআবাবিল ইউনিয়নে এখন কম-বেশি একটি করে ছোট্ট খামার অনেকের বাড়িতেই রয়েছে। রাছেলকে দেখে অনেকেই উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। তবে এর বেশিরভাগই দেশীয় প্রজাতির।
কেউ দূধ বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন, আবার কারো বছর শেষে গরু বিক্রি করেও আয় হচ্ছে লাখ টাকা। কেউ পরিবারে ছোট ভাই-বোনদের পড়াশোনার খরচ যোগাচ্ছেন। নিজের গ্রামে বেকার যুবকদের উদ্বুদ্ধ কর রাছেল। হাতে কলমে ট্রেনিং নিয়ে আজ স্বাবলম্বী কিছুটা।
উত্তর চরবংশী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হোসেন হাওলাদার বলেন, খামার করে সাফল্য অর্জন করেছেন অনেকে। তাই সরকারের কাছে প্রত্যাশা চরবংশীতে এখন যে পরিমাণ দুধ উৎপাদন হয়, সে পরিমাণে দুধ বিক্রির করার জায়গা নেই।
যদি সরকারিভাবে এই অঞ্চলে একটি দুগ্ধ শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যেত। দুধ থেকে সাধারণত যে সব খাদ্য তৈরি হয় তা ক্রয় করতে এই চরবংশীর মানুষকে আর বাইরে যেতে হবে না। দরকার সরকারের একটু স্বদিচ্ছা।
রায়পুর উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা আতাউর রহমান বলেন, রাছেল ঢাকায় একটি প্যাথলজিতে চাকুরির পাশাপাশি দু’দিন বাড়ীতে থেকে গরু ও ছাগলের খামার করা অসাধারণ। আমরা মুগ্ধ। প্রায় প্রতিদিনই তার খামারের খোঁজ নেয়া হয়।
গরু ও ছাগলগুলোকে ভ্যাকসিন দেয়া হয়। তার দেখায় অনেক যুবকও হাসপাতালে এসে পরামর্শ নিয়েছেন। সরকারের কাছ থেকে রাছেলকে সহযোগিতার জন্য আমরাও চেষ্টা করবো।