22 C
Dhaka
Saturday, November 23, 2024

একটি প্রাগৈতিহাসিক ও অস্পষ্ট আইন বিপজ্জনক এক অন্ধকারেরই পূর্বাভাস দিচ্ছে

বিডিনিউজ ডেস্ক

চাকুরির খবর

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আগুনে পুড়ে বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা যখন গোঙাচ্ছে তখন সাংবাদিক রোজিনার বিরুদ্ধে স্বাধীন দেশে ব্রিটিশদের বানানো এই আইনে মামলার মাধ্যমে কয়েক যুগ পর এই দানবীয় আইনকে জাগিয়ে তুলেছে সরকার।

আইন অমান্য করে কোনো অপরাধ সংঘটনের দায়ে যখন আপনি অভিযুক্ত হবেন তখন আপনি যাতে ন্যায় বিচার পান সেজন্য সংবিধান এবং রাষ্ট্রের অন্যান্য কিছু আইন আপনাকে সুরক্ষা দেবে।

তবে বেশ কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রশাসনের দুর্নীতি উন্মোচন করা অনুসন্ধানী সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে আটকের পর এবং তার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পুরো প্রক্রিয়াতেই আইনের শাসনের এই মৌলিক দিকটি লঙ্ঘিত হয়েছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের দ্বারা সরকারের প্রশাসনিক কেন্দ্রস্থল সচিবালয়ে অবরুদ্ধ থাকার ২৩ ঘণ্টা পর মঙ্গলবার দুপুরে রোজিনা ইসলাম যখন আদালতে জামিন আবেদন করেন তখন আদালত জামিনের শুনানি নাকচ করে তাকে কারাগারে পাঠান। 

‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নথির ছবি তোলা’র অভিযোগে রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে ১৯২৩ সালের অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে মামলা করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

দানবীয় এই আইনটি উপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশ রাজের রীতিনীতি ও কু-কর্মের সমালোচনা করলে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করতে প্রণয়ন করা হয়েছিল। 

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আগুনে পুড়ে বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা যখন গোঙাচ্ছে তখন সাংবাদিক রোজিনার বিরুদ্ধে স্বাধীন দেশে ব্রিটিশদের বানানো এই আইনে মামলার মাধ্যমে কয়েক যুগ পর এই দানবীয় আইনকে জাগিয়ে তুলেছে সরকার। 

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ও পুলিশ যেভাবে সিনিয়র সাংবাদিক রোজিনার সঙ্গে আচরণ করেছে, তা গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় যে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে তা বলার অবকাশ নেই।

সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিওগুলোতেও দেখা গেছে, তাকে লাঞ্ছিত করা হয়েছিল। রোজিনার বোন ও স্বামী অভিযোগ করেছেন, সচিবালয়ের ওই কক্ষে তাকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছিল। 

বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না।” অর্থাৎ সংবিধানের এই আইন রোজিনাকে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। 

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যে কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রোজিনা ইসলামকে লাঞ্ছিত করা ও শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে তিনি “নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩” এর তোয়াক্কাই করেননি যা সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন।

এটি একটি ফৌজদারি অপরাধ যার শাস্তি হিসেবে কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতনের মতো ফৌজদারি অপরাধের বিরুদ্ধে প্রণয়ন করা এই আইনও সুরক্ষা দিতে পারেনি রোজিনা ইসলামকে।

মামলাটি এখন আর কোনও ব্যক্তি রোজিনা ইসলামের নয়; গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সাংবিধানিক নিশ্চয়তা গুড়িয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভকে আঘাত করেছে এই মামলা। 

এ ঘটনার তাৎপর্য আরও অশুভ। রোজিনার সঙ্গে করা নিষ্ঠুর, অমানবিক ও অবমাননাকর আচরণের কারণে তথ্যের স্বচ্ছতা বজায় ও পক্ষপাতহীন প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রে নিজেদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন জেগেছে সাংবাদিকদের মনে।

যেসব সাংবাদিক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ প্রশাসনের দুর্নীতি ও অনিয়ম উন্মোচন করেন তারা এখন থেকে দ্বিধায় থাকবেন। আমলাদের কুকর্ম নিয়ে সংবাদ তৈরি করার জন্য ক্ষুব্ধ কর্মকর্তাদের রোষানলে পড়ার শঙ্কায় থাকবেন তারা।

তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে সাংবাদিকদের কাজ এবং গবেষণার জন্য বহু নথির ছবিই তাদের ফোনের গ্যালারিতে থাকে। এখন দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে করা একজন সাংবাদিকদের কোনো প্রতিবেদনের কারণে যদি কোনো কায়েমী গোষ্ঠীর স্বার্থ ক্ষুন্ন হয়, তখন সেই গোষ্ঠীটি সাংবাদিককে আটকে রেখে তার ফোন জব্দ করতে পারে এবং ওই মোবাইলে থাকা নথির ছবি ব্যবহার করে তার বিরুদ্ধে অফিশিয়াল সিক্রেটস আইনে মামলা জুড়ে দিতে পারে। প্রশাসনের দুর্নীতি উন্মোচন করা সাংবাদিকদের দমিয়ে দিতে নতুন একটা পদ্ধতি হতে পারে এটা। 
মাদক মামলায় লোকজনকে ফাঁসিয়ে দিতে দীর্ঘদিন যাবত একই ধরণের অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে। বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, পুলিশি ভাষায় যেটাকে বলা হয় ‘ক্রসফায়ার’, সেটিকে বৈধ করতে একজন সাধারণ ব্যক্তির বুকে বন্দুক ঠেকানোর অভিযোগও রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে। 

এই যদি হয় ঘটনা, তবে সাংবাদিকতা প্রশাসনের প্রোপাগান্ডা মেশিন ব্যতীত আর কিছুতেই পরিণত হবে না। রিপোর্টাররা তখন দুর্নীতি ও অনিয়মের উন্মোচন করার কাজ থেকে পিছিয়ে আসবে।

মন্ত্রণালয়ের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিই প্রচার করবে গণমাধ্যমগুলো। এটাকে তখন আর সাংবাদিকতা বলা যাবে না।

নাগরিকের বাকস্বাধীনতার অন্যতম মাধ্যম গণমাধ্যমের টুটি চেপে ধরলে সরকারি কর্মকর্তাদের দ্বারা জনগণের অর্থের ব্যয় কীভাবে ও কতোটুকু হচ্ছে তা জানার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে জনগণ।

এসব বিষয়ে তারা অন্ধকারেই থাকবে। কর্মকর্তারাও তাদের অন্যায় কাজের জন্য কোনো ধরনের জবাবদিহিতার মুখোমুখি হবেন না।

এই ধরনের একটি গোপনীয় পরিস্থিতি তৈরি করার সেরা হাতিয়ার হল অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট।

এই আইনটি এতোটাই অস্পষ্ট যে, এটি ‘সিক্রেটস’ শব্দের সংজ্ঞাও দেয়নি। কর্মকর্তারা যদি চান, তারা খাদ্যশস্য কেনার নথি থেকে শুরু করে ভ্যাকসিন কেনার নথিকেও ‘গোপনীয়’ এবং ‘জাতীয় নিরাপত্তা’র সঙ্গে সম্পর্কিত হিসেবে উপস্থাপন করতে পারবেন।

লক্ষ করুন যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা দাবি করেছেন যে রোজিনা ‘ভ্যাকসিন কেনার সাথে সম্পর্কিত গোপনীয় নথি’ এর ছবি তুলেছিল। আর স্বাস্থ্যমন্ত্রী তার মন্ত্রণালয়ের লোকজনের এই কর্মকাণ্ডকে আস্কারা দিয়ে বলেছেন, এই নথিগুলি জনসমক্ষে প্রকাশিত হলে দেশের ক্ষতি হতো।

ভ্যাকসিন কেনার চুক্তি কীভাবে গোপনীয় হয় ও এর সঙ্গে কীভাবে জাতীয় নিরাপত্তা জড়িত এটা একজন বোধবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের মাথায় কীভাবে আসে জানা নেই। তার মন্ত্রণালয় নিশ্চয়ই জাতীয় প্রতিরক্ষা এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সম্পর্কিত কোনও কিছুই পরিচালনা করে না। 

যেখানে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে গোপনীয়তার সংস্কৃতি ইতোমধ্যেই বেশি, সেখানে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের অপব্যবহার পরিস্থিতি আরও খারাপ করে দেবে।

জনগণের ট্যাক্সের টাকা প্রশাসন কীভাবে খরচ করছে তা জানতে করদাতের শেষ ভরসা যে গণমাধ্যম সেই গণমাধ্যম ‘গোপন নথি’র উপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন তৈরি করতে ঝুঁকি অনুভব করবে।

ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের অস্বস্তিকর প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে দ্বিধায় ভুগবেন সাংবাদিকরা। তখন অপকর্ম করার পরও জবাবদিহিতার জায়গা না থাকায় কিছুই আসবে যাবে না কর্মকর্তাদের। 

এ ধরনের গোপনীয়তার পরিবেশে অন্ধকার বৃদ্ধি পাবে এবং দুর্নীতি বেড়ে যাবে যা মারাত্মকভাবে আঘাত করবে দেশের অর্থনীতিকে।

চূড়ান্ত ক্ষতিগ্রস্থ হবেন সেইসব সাধারণ মানুষ যারা প্রশাসন পরিচালনার জন্য ও জনগণের টাকা জনকল্যাণে ব্যয়ের জন্য কর্মকর্তাদের বেতন এবং অন্যান্য ভাতা প্রদান করেন।

লেখক: উপ-নির্বাহী সম্পাদক, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড 

- Advertisement -

আরও সাম্প্রতিক খবর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -

সর্বশেষ খবর