...
Tuesday, January 14, 2025

আমাদের আনু ভাই

চাকুরির খবর

ছোট গল্প
আমাদের আনু ভাই
———————————জয়ন্ত পন্ডিত

ব্যাপারটা ছিল বর্ষাকালে কোকিলের ডাক শোনার মতই। কারণ তৃপ্তি মেডিকেল কর্ণারের আড্ডায় আনু ভাইয়ের মুখ থেকে প্রসঙ্গচ্যুত ‘তিনি কবি হলেও ভাল ছবি আঁকতে পারেন’- মন্তব্যটি আমরা কেউই আশা করিনি সেদিন।

এ কথা শুনে আমরা কেউ অবাক হয়েছিল কিনা তা এখন আমরা কেউ মনে করতে পারি না। তবে তৃপ্তি মেডিকেল কর্ণারের সত্বাধিকারী আমাদের সবার আনু ভাই আমাদের অবাক করে দেওয়ার জন্য কথাটা বলেছিলেন। আমারেদ মধ্যে যারা একটু চতুর তারা বলেছিল-আনু ভাই ইচ্ছা করে আমাদের মুগ্ধ করতে ওই কবির ছবি আঁকার প্রতিভার খবর আমাদের মধ্যে প্রচার করতে চান। চতুরেরা এও বলেছিল প্রতিভার প্রমাণ করতে একদিন আনু ভাইয়ের দরিদ্র ওই কবি ও চিত্রকরকে আমাদের সামনে হাজির করে তার মুখ থেকে জ্ঞান-প্রজ্ঞার কথা শুনিয়ে আমাদের ভেতর আরও একটা ঘোর সৃষ্টির চেষ্টা করবেন। যেমনটা আনু ভাই নিজে করেছেন; আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে তার মতো কবি আর প্রজ্ঞা বাগ্মী হওয়ার ঘোর সৃষ্টি করেছেন।

আনু ভাইয়ের সাথে আমাদের পরিচয় পাঁচ বছর আগে। তবু এখনো তার পুরো নামটা জানা হল না আমাদের। পরিচতজনেরা তাকে আনু ভাই, আনু, আন্নু মিয়া, আনোয়ার বলে ডাকতে শুনি। আবার কোন কোন দিন সন্ধ্যায় তার সমবয়সীরা এসে আন্নু বলে ডেকে আমাদের সামনে থেকে খানিক সময়ের জন্য দোকানের বাইরে নিয়ে যায়।আমাদের আনু ভাই সাহিত্যমনা লোক। তিনি ঘন্টার পর ঘন্টা রাজনৈতিক নেতার মত সাহিত্য নিয়ে কথা বলে যেতে পারেন। কখনো ক্লান্ত বোধ করেন না চড়–ই পাখির মত। আমরা পাঁচ বছর ধরে বেশির ভাগ সন্ধ্যায় তৃপ্তি মেডিকেল কর্ণারে বসে আনু ভাইয়ের কথা মুগ্ধ হয়ে শুনে যাচ্ছি। বাজার কাটতি উপন্যাসের মত আমাদের টানে আনু ভাইয়ের কথা। কথা শুনে পাঁচ বছরে আমাদের অনেকেই কবি আর আনু ভাইয়ের মত প্রাজ্ঞ হওয়ার চেষ্টায় গোপনে গোপনে মত্ত। আর চতুরেরা আড্ডা ভেঙ্গে যে যার বাসায় ফিরে যাওয়ার সময় আনু ভাইয়ের সমালোচনা করে। আবার পর দির সন্ধ্যায় তারাই আগের রাতে লেখা কবিতাটা আনু ভাইকে দেখিয়ে কবি আখ্যা পাওয়ার জন্য নিয়ে আসে।

পাঁচ বছরের পরিচয়ে আনু ভাই সর্ম্পকে আমরা জানতে পারি, আনু ভাইয়ের ভাষায় তার জবানিতে পঞ্চাশ। স্ত্রী সন্তন-স্বজনহীন একটা পুরানো আমলের টিনের ঘরে থাকেন খুব নিঃসঙ্গভাবে। সান্ধ্য আড্ডায় তিনি মাঝে মাঝে তার নিঃসঙ্গতার কথা আমাদের শোনান। শুনে কেন যেন আমাদের চোখে পানি এসে যায়; অনেকটা শীতকালেন বৃষ্টির মতো।

আনু ভাই আমাদের কাছে নিজেকে কবি বলে দাবি করেন। বলে বেড়ান প্রথম যৌবনে তিনি নাকি ৫০-৬০টি কবিতা লিখেছেন। সেগুলো নাকি সেই সময়ের প্রথম সারির দৈনিক খবরের কাগজে ছাপাও হয়েছে। তবে এখন কোনটিই তার সংগ্রহে নেই। নিজের উদাসীনতা আর নির্মোহতার কারণে হারিয়ে গেছে। মাঝে মাঝে তার কবি ভাব আমাদের মনে প্রশ্নের জন্ম দিলেও আমাদের বিশ্বাসে খুব বড় ফাঁটল ধরায় না। আমরা তার কবি প্রতিভার প্রমাণ পেতে বলি-আনু ভাই কবিতা ছেড়ে দিয়েছেন কেন? আপনার তো নি:সঙ্গ জীবন। তখন তিনি বলেন, আবার কবিতা লেখা শুরু করবেন। আবার জ্বলে উঠবেন; শেষ হওয়া আগে সিগারেটের ‘সুখ টানের মত’। তার জ্বলে উঠার প্রত্যয় আমাদের ভেতর সৃষ্টি হওয়া সব সংশয় জলীয় বাষ্পের মত উড়ে যায়।

আনু ভাই বেশ ভীতু প্রকৃতির লোক। মাঝে মাঝে বর্ষাকালের আকাশ গর্জনের রাতে নিজের ঘরে একা থাকতে পারেন না। সেসব রাতে তার সঙ্গী হয় পাড়ার উঠতি আরও একদল তরুণ। যারা সমাজে আমাদের মত মধ্যবিত্তের খোলসে বন্দি না। তারা সামাজিক ভাষায় ‘নি¤œবিত্ত’। গুরুজনের সামনে সিগারেট বা গাঁজা টানতে তার সংকোচ করে না। অথবা ওইসব রাতে আনু ভাইয়ের সঙ্গী হয় বাপের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া কোন বউয়ের স্বামী; যাদের তিনি সবার কাছে নিজের বন্ধু বলে পরিচয় দেন। আবার আমরা এও শুনি মাঝে মাঝে খুব সস্তা দামে পর পুরুষের সাথে রাত কাটানোর মত কোন মেয়েও তার ওইসব রাতের সঙ্গী হয়। আমরা এও শুনি আনু ভাই রাতের সঙ্গী যারা হয় তাদের সবাইকেই তিনি সাহিত্য নিয়ে সুন্দর কথার মায়াজালে মায়া হরিণের মত কাছে টেনে নেয়।

এভাবেই বর্ষাকাল শীতকাল কবিতার নানান জ্ঞান গল্পে আমাদের দিন চলে যেতে থাকে। আনু ভাইয়ের জীবনের ভেতর দিয়ে আমরা হাঁটতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। আমরা পরিচয়ের প্রধম দিকেই আনু ভাইয়ের মুখ থেকেই জেনেছিলেন ২৫ বছর আগে ভালবেসে তিনি বিয়ে করেছিলে এক রমণীকে। যার গায়ের রঙ ছিল বিদেশি মেমদের মত। আবার নাকেব নোলক, সীতাহার আর হাতের বালায় তাকে গ্রামের সহজ সরল এক মেয়ের মত লাগত। আর ভালবাসা ছিল ‘গাঙের ঢেউয়ের’ মত অবিরল।

বিয়ে করে যেদিন আনু ভাই বউ নিয়ে আসেন তখনও আপনজন বলতে একমাত্র মা-ই ছিল। আনু ভাই আমাদের শুনিয়েছেন- কোন এক কারণে তার এমন অপরূপ বউকে মায়ের পছন্দ হয়নি। হয়তো সেই অভিমানে আনু ভাইয়ের মা বিয়ের দিন দশেক পরই কোন এক রাতে ঘুমের ভেতর অচিন দেশে চলে যান।

তার কয়েক বছর পর আনু ভাইয়ের সেই অপরূপ বউও ভালবাসার ঘর ছেড়ে কোথায় যেন উধাও হয়ে যায়। কেন বা কি কারণে তা আমাদের অজানা। তারপর জীবনের বাকি সময়টা একা একাই পার করে দিলেন তিনি।

আমরা পাঁচ বছরে আনু ভাইয়ের কথার জাদুতে জড়িয়ে গেছি। তারপরও তার তথা মাঝে মাঝে অসহ্য লাগে আমাদের। মাথা ঝিম ঝিম করে ঠিক প্রথম দিন সিগারেটে টান দেওয়ার মত।

এখনো মাঝে মাঝে আমাদের চোখে ঝাপসা হয়ে ভেসে উঠে প্রথম দেখা আনু ভাইকে। কি র্স্মাাট লোক! কথা বলেন গুছিয়ে, যেন এক কল্পলোকের রাজকুমার। তারপর কত দিন তার দোকানে আড্ডা দিয়েছি। কতকিছু শিখেছি তার কাছ থেকে। তবে আনু ভাইয়ের এসব বিষয় আমরা যারা জানি তারা কোন দিনই তার রাতের সঙ্গী হয়নি।

আনু ভাইয়ের সাথে কথা বলতে বলতে আমাদের মাঝে বিশ বছরের বয়সের দেয়ালটা চীনের প্রাচীরের মত ভেঙ্গে গিয়েছিল আমাদের অজান্তেই। হয়তো এক সময় আনু ভাইয়ের নিঃসঙ্গতার কারণ ভেবে নিয়ে আমরা ভাবি মানুষ কেন নিঃসঙ্গ হয় অথবা নিঃসঙ্গ থাকতে চায়।

একদিন ঘোর বৃষ্টির সন্ধ্যায় আনু ভাই আমরা যারা কোন দিন তার রাতের সঙ্গী হইনি তাদের ডাকলেন। আমরা ভাইছিলাম লোকটার একাকিত্বের গল্প শোনে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেছি বলে বি দু:সাহসে আমাদেরকে রাতের সঙ্গী হতে বললেন। আমরা প্রথমে যাব না সিদ্ধান্তে অনড় ছিলাম। কিন্তু আমাদের মাঝে যারা চতুর তার যেতে রাজী। চতুরেরা বলল সবাই মিলে গেলে সংখ্যায় আমরাই তো বেশি। আনু ভাই আমাদের কিছুই করতে পারবে না। আমরা যারা বেশি ভীতু তারা সংশয় প্রকাশ করলাম।
ডেকে নেওয়ার পর যদি দেখি আনু ভাইয়ের বাসায় সমাজের ভাষায় ‘নি¤œরূপ’ তরুণেরা আছে…অথবা খারাপ মেয়ে মানুষ! তখন?
কিন্তু চতুরেরা আমাদের সব সংশয় উড়িয়ে দিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আমরা ভীতুরা রাজি না হয়ে পারি না।

আমরা যে যার বাসা থেকে মিথ্যা বলে গুরুজনের বুঝিয়ে আনু ভাইয়ের বাসায় যাই। আমাদের যে যার বাসা থেকে মিথ্যা বলে গুরুজনদের বুঝিয়ে আনু ভাইয়ের বাসায় যাই। আমাদের ভীতুদের সংশয় ভুলপ্রমাণিত হয়। ঘরে ‘নি¤œবিত্তরা’ বা ‘খারাপ’ কোন মেয়ে ছিল না। আনু ভাই বেশ খুশি খুশি ভাব নিয়ে আমাদের হাতে জল রঙের আঁকা একটা ছবি তুলে দিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন… ছবিটা কোন শিল্পীর আঁকা। আমরা মনে মনে জানতাম ছবির শিল্পীর নাম বলে তিনি তার প্রাজ্ঞ ভাষণ শুরু করে রাত কাটিয়ে দেওয়ার ফন্দি করেছেন। কিন্তু আমরা কেউ জলরঙে আঁকা সেই নারি মূর্তি থেকে চোখ সরাতে পারছিলাম না। ছবিটিতে যেন এক মাতঙ্গীনি নারীর প্রতিরূপ ছিল। যে সর্বদা জয়ে পরিতৃপ্ত হয়, পরাজয়ে নয়। যেন যুদ্ধ শেষে ফিরে আসা এক বীরের মত অহংকারী আর ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় ভরপুর দুটি চোখ।

আনু ভাইয়ের প্রশ্নের উত্তরে আমরা সবাই দেশি বিদেশি সব বিখ্যাত চিত্রশিল্পির নাম বলি। কিন্তু কেউ সঠিক হই না। অবাক হই আমাদের ব্যর্থতায় আনু ভাই খুশি হন না।

বাইরে মেঘের গর্জন। ভেতরে আমাদের অস্বস্তি। আনু ভাই কেন এখনো ছবির শিল্পির নাম বলে শিল্পির জীবন ও শিল্পকর্ম নিয়ে আমাদের সামনে তাঁর জ্ঞানগর্ভ কথার ভান্ডার খুলছেন না? শেষে আমরা যখন ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলি এবং বলি ছবিটি কার আঁকা না বললে বৃষ্টির মধ্যে ঘর থেকে বের হয়ে যাব, তখন আনু ভাই বলেন-ছবিটি ওই দরিদ্র কবির আঁকা। আমরা উৎসুক হয়ে জানতে চাই ছবির নারীটি কবির পরিচিত কেউ কি না?।

আনু ভাই আমাদের নিরাশ না করে বলেন, ছবিটি আমার হারিয়ে যাওয় বউয়ের। আমরা আনু ভাইকে প্রশ্ন করি কবির সাথে আপনার পরিচয় তিন বছর আগে। কিন্তু আপনার বউতো তারও অনেক অনেক আগে চলে গিয়েছিলেন নিরুদ্দেশে।

আনু ভাই বলেন, কবি তো জাত শিল্পি। আমার কাছ থেকে চলে যাওয়া বউয়ের নাক মুখ চোখ ঠোঁট গায়ের রঙ আর ভালবাসার গল্প শোনে কবি অবিকল আমার বউয়ের ছবি এঁকেছেন। আনু ভাইকে কেমন উদাস লাগে। তিনি আমাদের সামনে ঘরের ভেতর পায়চারি করতে করতে বলেন- বলেছি না, ওই কবি জাত প্রতিভা। বর্ণনা শুনে আমার বউয়ের ছবি অবিকল এঁকে দিয়েছেন।

- Advertisement -

আরও সাম্প্রতিক খবর

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -

সর্বশেষ খবর

Seraphinite AcceleratorOptimized by Seraphinite Accelerator
Turns on site high speed to be attractive for people and search engines.