37 C
Dhaka
Friday, April 19, 2024

সংবাদমাধ্যমে ‘ইঁদুর দৌড়’

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা | ঢাকা | ১২ই আগস্ট, ২০২১ খ্রিস্টাব্দ, বৃহস্পতিবার, ২৮শে শ্রাবণ, ১৪২৮ বঙ্গাব্দ , বর্ষাকাল, ৪ঠা মহর্‌রম, ১৪৪৩ হিজরি

চাকুরির খবর

সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাসরুর আরেফিন যে প্রতিবাদ করেছেন, সেটা অনেকেই করেন না, তার আগেই মরমে মরে যান।

তিনি তো অন্তত নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন।  যদি তিনি বলতেন, আচ্ছা আমি পরীমণিকে গাড়ি দিয়েছি, তো কী হয়েছে, সেটা সবচেয়ে ভালো হতো। আমরা বিশ্বাস রাখতে চাই তার অবস্থান যে তিনি এরমধ্যে কোনোভাবেই ছিলেন না।

প্রমাণ নেই, তথ্যও নেই, অথচ কিছু পত্রিকা (এরমধ্যে অত্যন্ত স্বনামখ্যাত পত্রিকাও আছে) এবং অনলাইন পরীমণিকাণ্ডে দেশের এই মেধাবী ব্যাংকার ও কথাসাহিত্যিককে জড়িয়ে নিয়ে গল্প লিখেছে।

তিনি দেশের হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে একটি বিনিয়োগ সেমিনারে থাকা অবস্থায় তার সঙ্গে কোনও প্রকার আলাপ ছাড়া এই নিউজ সিন্ডিকেট আকারে লেখা হয় এসব সংবাদমাধ্যমে। এবং কোনও তদন্ত কর্মকর্তার নাম নিয়ে, এমনকি পরীমণির মুখ থেকে সরাসরি না শুনে, শুধু সূত্র জানিয়েছে বলে এই নিউজ করা হয়েছে। এখন ডিএমপি কমিশনার বলছেন, পরীমণির সঙ্গে কার কী সম্পর্ক ছিল এমন কোনও তালিকা হয়নি।

প্রতিবাদের জন্য মাসরুর ফেসবুককেই বেছে নিয়েছেন, কারণ আজকাল কোনও সংবাদ বা তথ্য প্রমাণের আগেই, ফেসবুকে বা ইউটিউবে ট্রল শুরু হয়। ‘নায়িকা পরীমণির সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে হলুদ সাংবাদিকতা’ শীর্ষক ওই পোস্টে মাসরুর আরেফিন বলেন, ‘আমার কোনও কিছু বলার ভাষা নেই।

আমি এই মর্ত্যের পৃথিবীতে, এই ধরাধামে পরীমণি নামের কাউকে দেখিনি। অতএব, তার নাম্বার আমার কাছে থাকার প্রশ্নই আসে না। এমনকি ‘বোট ক্লাব’ ঘটনার আগে পর্যন্ত পরীমণি নামটাও শুনিনি। আমার তখন মানুষকে জিজ্ঞাসা করতে হয়েছিল যে কে এই পরীমণি?’

পরীমণির সঙ্গে তার সত্যিই কোনও যোগাযোগ আছে কিনা সেটা নিশ্চয়ই এক সময় জানা যাবে। কিন্তু তার আগেই যে ভয়ংকর গালি আর অপমানের শিকার হলেন মাসরুর বা অন্য কেউ– এর কোনও প্রতিকার কি আছে? না, নেই। আর  নেই বলেই গণমাধ্যমের দায়িত্বটা এই সামাজিক মাধ্যমের যুগে অনেক বেশি।

সামাজিক সুস্থিতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে কী ভূমিকা রাখছে তথাকথিত সামাজিক মাধ্যম সেটা আমরা জানি না। কিন্তু বাংলাদেশে এই মাধ্যমে যুক্তিসঙ্গত বিতর্ক বলে কিছু নেই, যা আছে তা কেবলই কোনও প্রমাণ ছাড়া কোনও মানুষের চরিত্র হনন। বিভিন্ন ব্যক্তি, সাংবাদিক, ধর্মীয় সম্প্রদায় ও নেতা, রাজনৈতিক ব্যক্তি ও দল, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সফল করপোরেট সিটিজেনদের টার্গেট করে চলছে অসত্য এবং অর্ধসত্যকে বৈধতাদানের এক নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া। এটাকে আবার একশ্রেণির মানুষ সাংবাদিকতাও বলছেন।

এমনই এক দুর্ভাগা দেশ। একটা জিনিস বোঝা যায়, কোন কারণে দেশ থেকে যেসব সাংবাদিক বিদেশে গেছেন বা যেতে বাধ্য হয়েছেন, তারাই বিশিষ্টজন, আর কারও কোনও যোগ্যতা নেই।

কে কীভাবে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করবেন, সেটা যার যার নিজস্ব বিষয়। কিন্তু দূরে, নিরাপদ জায়গায় অবস্থান করে,কুৎসা আর চরিত্র হননের যে অবিরাম অনুশীলন তারা করছেন, তার জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার কোনও উপায় নেই। এবং এটাই তাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী,বা মৌলবাদী চক্র নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে বিকৃত খবর, মিথ্যা খবর ছড়াচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে এবং তাদের নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন অনলাইনে। এদের দেখলে মনে হবে অনর্গল ফেইক নিউজের ভুবনে বাস করছি আমরা।

কিন্তু তার প্রতিযোগী মূল ধারার মাধ্যম হবে কেন? প্রশ্ন হলো মূল ধারার গণমাধ্যম কী করে এই কাজ করে যেখানে অনেক প্রথিতযশা সাংবাদিকও কাজ করছেন। এদের কাণ্ডকারখানা দেখে মনে হয়, সাংবাদিকতার দিন হয়তো গেছে এই দেশে।

এমনিতেই আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ, প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ, মালিকের নিয়ন্ত্রণ, বিজ্ঞাপনদাতাদের নিয়ন্ত্রণ, রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ, সাম্প্রদায়িক শক্তির ক্রমাগত হুমকির মধ্যে কাজ করতে হয় দেশের সাংবাদিকদের। তার ওপর যদি নিজেরাই এমন ফাঁদে পড়ে সাংবাদিকরা তাহলে গন্তব্য কোথায়?

আমরা দেখি বিভিন্ন ঘটনায় গ্রেফতার করার পরে নারী ও পুরুষদের গণমাধ্যমের সামনে হাজির করে পুলিশ বা র‌্যাব। সেখানে জব্দ করা জিনিসপত্র সাজিয়ে গণমাধ্যমের সামনে তাদের উপস্থাপন করা হয় ও নানা বর্ণনা তুলে ধরা হয়। এটি আসলে ক্ষমতার অপপ্রয়োগ। বিচারের আগে বিচার।

দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়ায় তারা দোষী প্রমাণিত না হলেও জনমনে ঠিকই দোষী বলে চিহ্নিত হয়ে যাচ্ছেন। অনেকের ক্ষেত্রে নানারকম আপত্তিকর বিশেষণও ব্যবহার হয়। এরকম কর্মকাণ্ড বন্ধ করার বিষয়ে ২০১২ সালে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল হাইকোর্ট। তারপরেও সেটি বন্ধ হয়নি। অনেকে বলেন, পুলিশ না হয় করে, মিডিয়া কেন করে এমনটা?

এটাও কিন্তু ঠিক যে, এসব তল্লাশি বা অভিযানের সময় মিডিয়া যেভাবে জনসমাবেশ গড়ে তুলে লাইভ চালাতে থাকে, সেটা নিশ্চয়ই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলে দেয় না যে এভাবে করেন।

এখানেই প্রাসঙ্গিক সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানের। আমাদের ব্যর্থতা আমরা সেটা গড়ে তুলতে পারিনি। তাই ইঁদুর দৌড়ে মেতেছে সাংবাদিকতা। এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা। একটা কথা বলতেই হয়, পুলিশে যেমন ভালো-খারাপ আছে, চিকিৎসকদের মধ্যে আছে, শিক্ষকদের মধ্যে আছে, তেমনি সাংবাদিকদের মধ্যেও ভালো ও খারাপ, সাদা এবং কালো, এই ভিন্নতা থাকাটাই স্বাভাবিক।  সব ব্যবস্থাতেই যদি ঘুণ ধরে,তবে সংবাদমাধ্যম ব্যবস্থায় ঘুণ ধরবে না কেন–এমন কথাও বলছেন অনেকে।

এসব বলে আসলে আমরা নিজেরা হাত ধুয়ে ফেলতে পারবো না। একজন সাংবাদিকের একটি স্বাধীন ভূমিকা থাকে। সেটা যতটা সম্ভব প্রয়োগ করতে সচেষ্ট থাকতে হয় এবং সেটা এক নিরন্তর লড়াই। এবং যেকোনও বিষয়ে, বিশেষ করে, সামাজিক মাধ্যমের ট্রলের যুগে ন্যায্যতার প্রশ্নটি কোনোভাবেই ভুলে যাওয়া যায় না।

টেলিভিশনের জন্য টিআরপি প্রতিযোগিতা আর পত্রিকার জন্য সার্কুলেশনের সঙ্গে দৌড়ানো এমন জায়গায় গেছে যে, কোনও সুস্থির চিন্তা করা যাচ্ছে না।

আমি না দেখালেও দেখাবে, আমি না ছাপলে অমুকে ঠিকই ছেপে দেবে–এমন ভাবনায় কোনও সুস্থতার জায়গা আর থাকছে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রতিযোগিতার এই বাজার সর্বস্বতায় প্রতিষ্ঠানকে নিয়মিত হারিয়ে দিচ্ছি আমরা।  

তবে কি আমরা কেবল হারতেই থাকবো?

লেখক: সাংবাদিক

বাংলা ট্রিবিউন  

- Advertisement -

আরও সাম্প্রতিক খবর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -

সর্বশেষ খবর