করোনা ও বর্তমান প্রেক্ষাপট
♦রিয়েল আবদুল্লাহ
কী অদ্ভূত আমরা এই বাঙ্গালি জাতি। আমাদের সাহস সম্ভবত এত বেশি যে আমরা মৃত্যুকেও ভয় পাই না। যখন কোভিড-১৯ এ মৃত্যুর সংখ্যা ১(এক) ছিলো আমরা নানা রকম উদ্ভট কথা বলে গেছি। কোভিড -১৯ কিছুই না। নানা জনে নানা কথা বলে গেছে। কেউ দিয়েছে হিট থিউরি , কেউ দিয়েছি ধর্ম থিউরি কেউ দিয়েছে সুরা থিউরি কেউ দিয়েছে কোল্ড থিউরি। স্বয়ং স্বাস্থ্যমন্ত্রী মহাশয় দ্বন্দ্বে ভুগেছেন এই করোনা নিয়ে। কি করবেন তার সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পারেননি। কোন মন্ত্রী কিংবা এমপি বা সাংবাদিক সাধারণ মানুষ করোনাকে আমল দিয়ে কথা বলেননি। সকলেই যেন নির্মোহ ছিলেন। বিদেশ থেকে আগত প্রবাসীদের কোয়ারান্টাইনে নিতে ধকল পোহাতে হলো। বিমানবন্দরে কোভিড -১৯ নিরাপত্তা ছিল অপ্রতুল। প্রবাসীরা কেউ কোয়ারান্টাইন নিয়ম মানলো না অধিকন্তু উনারা বুক ফুলিয়ে ঘুরাঘুরি শুরু করলেন । করোনা আক্রান্তরাও গোপণ করল যে তারা আক্রান্ত। চারিদিকে আক্রান্তরা নতুন আক্রান্ত সংখ্যা বাড়িয়ে তুললো। মৃত্যু সংখ্যা অনুপাতে বাড়তে থাকল। আক্রান্ত সংখ্যার সুচকও লাফিয়ে বাড়তে থাকলো।সারাবিশ্বে যখন মৃত্যুসংখ্যা লাখ পেরিয়ে গেল তখন বাংলাদেশে একমাত্র প্রধানমন্ত্রী নিজে সাহসী উদ্যোগ নিলেন, তিনি জাতির পিতার জন্মানুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত করলেন। বললেন -অনুষ্ঠান পরেও করা যাবে আগে জনগণ। তখনই সকলে যেন নড়েচড়ে বসলেন। তখন সকলে একটু একটু অনুভব করতে লাগলেন যে করোনা একটা কিছু। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে লকডাউন ঘোষণা হলো। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এই যে আত্মচেষ্টা কেউ সঠিক বাস্তবায়নে এলেন না। অধিকন্তু বিজেএমইএ প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে সরকারের উপর চাপ বাড়িয়ে তুললো যাতে গার্মেন্টস সেক্টর খুলে দেয়া হয়। তাই হলো সীমিত আকারে খুলতে গিয়ে আবার শ্রমিকদের নিয়ে আসা হলো কর্মস্থলে। যা ছিল আরেকটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। অন্যান্য কর্মস্থলেও ভীর বাড়তে থাকলো।
যানবাহন চলাচল বন্ধ হলো। সাধারণ ছুটি ঘোষণা হলো। সকল প্রতিষ্ঠান মানলেও মানলো না গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠান। উনারা দুদিন পর ছুটি দিলেন। এই সিদ্ধান্তও ছিলো পুরোটাই আত্মঘাতী। লক্ষ লক্ষ শ্রমিক লম্বা ছুটি পেয়ে বাড়ি যেতে শুরু করে। যানবাহন বন্ধ হলেও ট্রাক পিক আপ দিয়ে বা পায়ে হেঁটে রিক্সা ভ্যানে যে যেভাবে পারলো বাড়ি গেল। সাধারণ ছুটি শেষ হবার আগেই গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষ গার্মেন্টস খুলে দিলো। পুলিশের সবধরনের ব্যারিক্যাড ভেঙ্গে তারা আবার কর্মস্থলে গেল। ঠিক তার একদিন পরে ঘোষণা এলো গার্মেন্টস সেকটর বন্ধ। আবার লক্ষ লক্ষ শ্রমিক একইভাবে কর্মস্থল ত্যাগ করল। কিন্ত ভাগ্য যা হবার হলো করোনা এটমবোমের বিস্ফোরণের মতো ছড়িয়ে পড়ল।
এর পর শুরু হলো ত্রাণের নাটক। প্রধানমন্ত্রীর সঠিক নির্দেশ উপেক্ষা করে ত্রাণ নিয়ে নানান টালবাহানা শুরু হলো। প্রায় চারশত জনপ্রতিনিধি ত্রাণচুরি করেন। ত্রাণ দিতে গিয়ে সামাজিক দুরত্ব মানা হলো না। এদিক সেদিক ত্রাণ লুটপাটের ঘটনা ঘটল।
মৃত্যু ও আক্রান্ত সংখ্যা বেড়েই চলল। আইইডিসি আর নিয়মিত ঘোষণা দিয়ে যেতে থাকলো করোনার ভয়াবহ খবর। শিক্ষিতজনেরা সতর্ক হলেও সাধারণেরা মানলো না। তাঁরা সরকারি নির্দেশ মানতে উপেক্ষা করল। আর এখন মৃত্যু সংখ্যা চারশ পেরিয়ে গেছে। আক্রান্ত সংখ্যাও বড় বড় দেশের সমতায় এসে দাঁড়ালো।
এই যে এত মৃত্যু এত আক্রান্ত তবুও মানুষ সতর্ক নয়। কেউ অনুভবেই নিচ্ছে না যে করোনা ভয়ংকর। ধর্মীয় নেতারা মসজিদ বন্ধের পক্ষে গেলেও মসজিদে ও বিভিন্ন জানাজায় লোক সমাগম হতেই থাকল।
এই যে ঈদ এল। বন্ধ ঘোষণা হলো। আগের মতো আবার ট্রাক পিক আপ ভ্যানে করে মানুষ গ্রামের দিকে ছুটছেই। সাথে নিয়ে অদৃশ্য মৃত্যুবীজ। মার্কেটগুলো নামে মাত্র বন্ধ। দেদারসে চলছে কিছু কিছু এলাকায়। কিন্তু রিপোর্ট যাচ্ছে বন্ধ।
দেখা গেছে করোনা রোগীকে আনতে এ্যাম্বুলেন্স বাড়িতে আর কোরোনা রোগী ইদের মার্কেটে। কেউওই মানছে না কোভিড-১৯ ভয়ংকর। প্রসাশনের নির্দেশ উপেক্ষা চলছে অহোরহ।
অন্যদিকে যদি বলি পূঁজিবাদের চামুণ্ডাদের হাতে সরকারের হাত বাঁধা। কীভাবে? প্রথম লকডাউনে যদি সাধারণ ছুটি ঘোষণার সাথে সাথে বৃহত্তর সেকটর গার্মেন্টস সেকটর তা মেনে নিতো আর মাত্র চৌদ্দদিন ধৈর্য ধরত, আবার শ্রমিকেরা ত্রাণ ত্রাণ করে পাগল হয়ে না ঊঠতো,সরকার যা দেয় তা নিয়ে সন্তোষ্ট থাকতো তাহলে করোনা এতটা ছড়তো না, তা সরকারী আমলা মন্ত্রী ও সরকার নিয়ন্ত্রিত সাংবাদিকদের বাইরে অন্যান্যরা যারা কবি সাহিত্যিক সুশীল সমাজের লোকজন তা মনে করেন।
তথ্যগোপণ অন্য একটি প্রক্রিয়া যা কোভিড -১৯ এর চাইতে ভয়ংকর। প্রথম থেকে যদি কোভিড -১৯ এর ভয়াবহতা কে স্বাভাবিক না নিয়ে সঠিক তথ্য গণমাধ্যমে প্রচার করা হতো,তাহলে বাঙ্গালী মানুষের মনে কোভিড ভীতি জাগতো,মানুষ সতর্ক হতো। মানুষ সতর্ক হয়নি। সকলের মনে পূঁজিবাদের একটা আবহ যাকে বলে বিপদের মধ্যেও অর্থচিন্তা,প্রবল ধ্বংসযজ্ঞের মাঝে,যুদ্ধের মাঝে,প্রাকৃতিক দূর্যোগের মাঝে অর্থচিন্তা। যা বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে দেখা যায় জীবনের চাইতে অর্থের দিকে বেশি ঝোঁক। যাঁর প্রতিফলে আজকের এই ঘোষিত বিশ সহস্রাধিক এফেক্টেড এবং চার শতাধিক মৃত্যু।
ঢালাও ভাবে সরকারকে দোষী না। সরকারের কিছু ক্ষমতালোভী অযোগ্য লোক রয়েছে যাঁরা চারশত মৃত্যুর পরও একটু মর্মাহত হয় না দায়িত্ব অবহেলার দায় স্বীকার করে না, ক্ষমতা আঁকড়ে বসে থাকে। তাঁরাই মূলত এর স্প্রেডের জন্য দায়ী।সরকার বলতে আমি শেখ হাসিনাকে বুঝি যেহেতু সামান্য ছোট কাজেও উনার ডিসিশন লাগে।তিনি এই বিপদে দুহাত খুলে উজার করে দিয়েছেন। লক্ষ হাজার কোটি টাকার মতো প্রণোদনা দিয়েছেন।দেশের মানুষের শান্তি সহায়তার জন্য।
শুধু প্রণোদনাই নিচ্ছে সতর্ক হচ্ছে না কেউ। যেন এই মৃত্যু কিছু না অতি সামান্য। মৃত্যু যেন সবুজ সবজি।প্রতিদিন ব্যাগভর্তি নিয়ে না গেলে প্রশান্তি আসে না মনে। এই সচেতনতার অবহেলা থেকে এই কোভিড বাড়ছে ক্রমাগত। যারা এর চিকিৎসার সাথে জড়িত তাঁরা আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। যাঁরা সেবামূলক কাজে রয়েছে তাঁরাও হচ্ছে আক্রান্ত। যা বিপদজনক। অথচ দেশের ক্রান্তিকালে তাঁদেরই বেশি প্রয়োজন।
তবে আশার কথা। বাংলাদেশের আমাদের ইমিউনিটি পাওয়ার বেশি। এক শরীরে হাজারো রোগের বাসা নিয়েও আশাহত হই না। শুধু মরে গেলে ইমানী জোর সাথে সাথে কবরে চলে যায়।
যাই কিছু হোক আত্মঘাতী বাঙ্গালী কথা শুনবে না। লকডাউন করে রেখে জীবন যাত্রার গতিকে স্থবির করে রাখার মানে হয় না।
শুধু একটাই চিন্তা আমাদের জীবন একটাই। মরে গেলে সব শেষ। তবুও এই দীর্ঘমেয়াদী মহামারিতে দেশ ও দশের কথা চিন্তা করে সব কিছু খুলে দিতে হবে। আর বসে থাকা যাবে না। প্রধানমন্ত্রীও তাই চান। শত দোষেও কোন পক্ষকে আর দোষাদোষি নয়।
সকলকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার নিয়ম মানতে হবে। সেনিটাইজ মেনে চলতে হবে। এহেন পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকার একটাই সূত্র নিজেকে নিরাপদ রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। নিয়ম মানুন বেঁচে থাকুন -মানবেন না মৃত্যুর সাথে সন্ধি করুন। তবে করোনা আক্রান্ত হলেই মানুষ মরে না।মনোবল চাঙ্গা রাখুন। ইমিউনিটি বাড়ে এমন খাবার খান, সুস্থ থাকুন।
রিয়েল আবদুল্লাহ
কবি ও সম্পাদক
লিটলম্যাগ রূপান্তর ময়মনসিংহ